

শনিবার ● ২৯ মার্চ ২০২৫
প্রথম পাতা » সুন্দরবন » ঈদ সামনে রেখে সুন্দরবনে হরিণ শিকারিচক্র বেপরোয়া
ঈদ সামনে রেখে সুন্দরবনে হরিণ শিকারিচক্র বেপরোয়া
ঈদকে সামনে রেখে সুন্দরবনে চোরাশিকারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা বাড়লেও বেপরোয়া চোরাশিকারিরা। তারা সারা বছরই এ বনে হরিণ শিকার করে। বন সংলগ্ন স্থানীয় কয়েকটি চোরাশিকারি চক্র উৎসবকে সামনে রেখে বেপরোয়া হয়ে উঠে।
সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যাও বেড়েছে আর চোরাশিকারিরাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।। সারা বছরই এ বনে হরিণ শিকার করে স্থানীয় চিহ্নিত কয়েকটি চোরাশিকারি চক্র। তারা ঈদ সামনে রেখে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। স্থানীয়রা বলছেন, ঈদের মতো উৎসব এলেই সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় হরিণের মাংসের চাহিদা বেড়ে যায়। অভিজাত ব্যক্তিদের হরিণের মাংস দিয়ে উৎসব উদযাপনের চাহিদা পূরণে এ সময় স্থানীয় চোরাশিকারিদের তৎপরতা বাড়ে সুন্দরবনে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে হরিণের। এবনে চিত্রা হরিণের সংখ্যাই বেশি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) জরিপের তথ্যমতে, বর্তমানে সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টি হরিণ রয়েছে। এর আগে ২০০৪ সালের জরিপে হরিণের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার। তবে একদিকে যেমন হরিণের সংখ্যা বাড়ছে, তার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে চোরাশিকারিদের অপতৎপরতা।
বন বিভাগ ও পুলিশ বলছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে আটক হরিণ শিকারিদের দেয়া তথ্যে দেখা গেছে, বনের পাশে যাদের বাড়ি, তারাই বেশি হরিণ শিকারের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর এবং বাগেরহাটের মোংলা ও শরণখোলার মানুষ বেশি হরিণ শিকার করে। এসব উপজেলার গ্রামগুলোয় বসবাসকারীদের বেশির ভাগই শ্রমজীবী মানুষ। তাদের প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ সুন্দরবনকেন্দ্রিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত সুন্দরবন থেকে ৭৫৭ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ৩৬টি। আসামি করা হয়েছে ৮৪ জনকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫১৪ কেজি ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫২৩ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করা হয়েছিল।
মাঝেমধ্যে দুই-একটি অভিযানে হরিণের মাংস, চামড়া, মাথা উদ্ধার হলেও মূল চোরাশিকারি ও পাচারকারী আটক হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হরিণের মাংস বহনকারীরাই ধরা পড়ে। আর যারা আটক হয়, তারা দুর্বল আইনের ফাঁক গলিয়ে কয়েকদিন পর জেল থেকে ফিরে একই কাজে লিপ্ত হয়।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বনজ সম্পদ আহরণসহ নানা উপায়ে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের আয় কমেছে। যে কারণে বনজীবীদের কেউ কেউ জীবিকার তাগিদেও এসব কাজে লিপ্ত হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, পেশাদার শিকারিরা গোপনে সুন্দরবনে ঢুকে নাইলনের দড়ির ফাঁদ পেতে রাখে। চলাচলের সময় হরিণ সেই ফাঁদে আটকে যায়। এসব শিকারি বনে প্রবেশের সময় ফাঁদ বহন করে না। জেলের ছদ্মবেশে তারা মাছ ধরার জালের সঙ্গে দড়ি নিয়ে বনে যায়। বনের ভেতর বসে সেই দড়ি দিয়ে হরিণ ধরার ফাঁদ তৈরি করে। তারপর হরিণের যাতায়াতের পথে ফাঁদ পেতে রাখে। সেই ফাঁদে হরিণ আটকা পড়লে বনের ভেতরে মাংস কেটে লোকালয়ে এনে বিক্রি করে। আর চামড়া, মাথা, শিংসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্থানীয় পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে পাচার করা হয়। এগুলো শৌখিন ব্যক্তিরা সংগ্রহ করে ড্রইং রুম সাজান। শিকার শেষে ফিরে যাওয়ার সময় ফাঁদগুলো বস্তায় ভরে জঙ্গলের ভেতর মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখা হয়। সুযোগ পেলে তারা আবার শিকারে আসে।
এসব শিকারির সঙ্গে যোগাযোগ থাকে এজেন্ট-ব্যবসায়ীদের। এই এজেন্টদের মাধ্যমে কখনো অগ্রিম অর্ডার, আবার কখনো মাংস এনে তারপর বিক্রি করা হয়। এ চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায় হরিণের মাংস। সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় প্রতি কেজি হরিণের মাংস ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় পাওয়া যায়। তবে জেলা শহরে প্রতি কেজি হরিণের মাংসের দাম ১০০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত। আর আস্ত একটি জীবিত হরিণের দাম চাওয়া হয় ১৫-২০ হাজার টাকা।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এজেডএম হাছানুর রহমান জানান, ঈদ উপলক্ষে এক শ্রেণীর অসাধু লোক সুন্দরবনের হরিণ শিকারে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তবে তাদের দমনে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সীমিত করা হয়েছে বনরক্ষীদের ছুটি। বিশেষ জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ছুটি দেওয়া হবে না। ঈদকে সামনে রেখে প্রতি বছর চোরাশিকারি চক্র মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এদের প্রতিরোধে বনরক্ষীদের বিশেষ টহল কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বনের পর্যটন এলাকাগুলোয় ইকোট্যুরিস্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ সার্বক্ষণিক টহল জোরদার করা হয়েছে।