

বুধবার ● ৯ এপ্রিল ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বাংলার লোকজ উৎসব মেলা
বাংলার লোকজ উৎসব মেলা
প্রকাশ ঘোষ বিধান ঃ
মেলা বাংলাদেশের জনপ্রিয় লোকজ উৎসব। মেলা শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে আনন্দের অনুভূতি হয়। মেলার আক্ষরিক অর্থ মিলন। মেলা হল এমন একটি দিন যখন ধর্মীয় উপাসনার জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষ একত্রিত হয়। একটি জায়গায় অনেক লোকের সমাবেশ ও সমাগম মানেই সাধারণ বাংলা অর্থে মেলা বলা হয়। মেলা হলো মানুষের এক আনন্দ সম্মিলন। বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যের ধারায় মেলা অন্যতম অনুষঙ্গ।
বাঙালির অস্হি-মজ্জায় উৎসবকলা আর পালপার্বণের ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্তি। বাঙালির এক অনুপম উপদান হলো বাঙালি সংস্কৃতি। ভাবের বাহন যেমন ভাষা, তেমনি একটি জাতির পরিচয় বহন করে তার সংস্কৃতি। অন্যসব জাতির সংস্কৃতি থেকে বাঙালিকে এক অনন্য অসাধারণ রূপ দান করেছে। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। সারাবছরই লেগে থাকে নানা উৎসব, পালা-পার্বণ।
বাংলাদেশের লৌকিক উৎসব হিসেবে মেলা অত্যন্ত জনপ্রিয়। মেলার সূত্রপাত হয় প্রাগঐতিহাসিক যুগে কোন স্থানে লোক সমাবেশ থেকে। পরবর্তীতে ধর্মীয় কারণে কোন পুণ্যস্থান বা তীর্থস্থানে অথবা সিদ্ধ ব্যক্তির স্মরণে যে ধর্মীয় সমাবেশ হতো, সেই সমস্ত সমাবেশ থেকেই মেলার উৎপত্তি। মেলা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দের উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন শব্দ থেকে যার অর্থ সম্মান প্রদর্শনের জন্য উদযাপন বা উৎসব। প্রথম মেলাগুলি ধর্মীয় উৎসবে অনুষ্ঠিত হত। এদেশে মেলার উৎপত্তি হয়েছে মূলত গ্রাম-সংস্কৃতি হতে। বাংলায় নানা ধরণের ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠান ও উৎসবের সূত্র ধরেই মেলার উৎপত্তি হয়েছে। সামাজিক, ধর্মীয়, বাণিজ্যিক বা অন্যান্য কারণে এক স্থানে অনেক মানুষ একত্রিত হলে মেলায় রুপ নেয়। এদেশের মেলার প্রাচীনত্ব হাজার বছরের পুরানো।
একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর আগেও এ দেশের বহু অঞ্চলে নানা লোকজ দেবদেবীর পূজা, অনুষ্ঠান এবং বিনোদনসহ উৎসব প্রচলিত ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূর্তির অস্তিত্বের বদলে শুধু তাদের নামেই আয়োজনের ঘটা হতো গাছতলা, প্রান্তর, বড় প্রাঙ্গণ, নদী কিংবা দিঘি বা জলাশয়ের পাড়ে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ গাছ, গাছের ডাল, পল্লব, মাটির ঘট, শোলা, বেত, বাঁশ ইত্যাদি সহজলভ্য উপকরণে কল্পিত ও সজ্জিত হয়েছেন দেবদেবী।বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার অনুন্নত পল্লী অঞ্চলে এখনো বনে-জঙ্গলে, বৃক্ষতলে, দিঘি-পুকুর-নদীপাড়ে, ক্ষেতখামার, বাঁশঝাড়ে নানা রকম অপৌরাণিক লৌকিক দেবদেবীর পূজা ও সে উপলক্ষে উৎসব এবং মেলার আয়োজন দেখা যায়। লক্ষ্মণসেনের (১১৭৯ – ১২০৬ খ্রি.) অন্যতম প্রধান সভাকবি গোবর্ধন আচার্য দ্বাদশ শতাব্দীতে লিখেছেন, হে কুগ্রামের বটবৃক্ষ, তোমাতে কুবের অথবা লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান থাক বা না থাক, মূর্খ গ্রামীণ লোকের কুঠারাঘাত থেকে তোমার রক্ষা হয় শুধু মহিষের শৃঙ্গ তাড়নায়। লক্ষণীয় যে আজও গ্রামজীবনের সাধারণ সংস্কার অনুযায়ী বট, পাকুড়, বেল, নিম, তুলসী ইত্যাদি গাছ আগুনে পোড়ানো হয় না। মনে করা হয় এসব বৃক্ষের সাথে দেবতাদের নিবিড় যোগ রয়েছে।
অতীতে মেলা মূলত গ্রামকেন্দ্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করলেও পরে মেলা গ্রামের পরিমণ্ডল অতিক্রম করে নগর-শহরে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশে এমন কোনো জেলা নেই যেখানে বছরের নানা সময়ে গ্রামে বা শহরে মেলা বসে না। তবে কবে থেকে এবং কীভাবে এ দেশে মেলার উৎপত্তি হয়েছে তা সঠিক করে বলার উপায় নেই।
আজকাল আমরা মেলায় বিভিন্ন ধরণের প্রদর্শনী দেখতে পাই। প্রাণী, উদ্ভিদ, শিল্পকলাসহ প্রদর্শনীগুলি মেলায় আনা হয় এবং এমন ব্যক্তিদের দ্বারা প্রদর্শিত হয় যারা সারা বছর ধরে নতুন দক্ষতা শিখতে বা বিদ্যমান দক্ষতা উন্নত করতে কাজ করেছেন। মেলায়, প্রদর্শনকারীরা তাদের শেখা জিনিসগুলি অন্যদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার সুযোগও পান।
কিছু প্রদর্শনী এমনকি পণ্য, বিশেষ করে কৃষিজাত পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য মেলাকে এক ধরণের বাজার হিসেবে ব্যবহার করে। এই ধরণের বাণিজ্য নতুন নয়। বাইবেলে ২,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মেলার প্রমাণ পাওয়া যায়। সেই সময়ে, মেলাগুলি বাণিজ্যিক প্রকৃতির ছিল, যার অর্থ ছিল ব্যবসায়ীদের পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের স্থান। এছাড়াও ইতিহাসের সেই সময়ে, গির্জা এবং রাষ্ট্রের কার্যক্রম ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল। প্রায়শই, ব্যবসায়িক কার্যক্রম এবং ধর্মীয় কার্যক্রম একে অপরের সাথে মিলিতভাবে অনুষ্ঠিত হত। মেলা এমন একটি দিন ছিল যখন ধর্মীয় উপাসনার জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষ একত্রিত হত। বড় বড় শহরগুলিতে বড় মন্দিরে পূজা অনুষ্ঠিত হত। এই প্রধান শহরগুলি অনেক দূরে ছিল, তাই যারা সমাবেশে যোগ দিতে চেয়েছিলেন তাদের মন্দিরে পৌঁছানোর জন্য অনেক দিন ভ্রমণ করতে হত। ভ্রমণকারীদের পুরো যাত্রার জন্য পর্যাপ্ত খাবার এবং বেঁচে থাকার সরঞ্জাম সঙ্গে করে নিতে হত। পবিত্র উৎসবগুলিতে বাণিজ্য করার জন্য ভ্রমণকারীরা অতিরিক্ত জিনিসপত্র বহন করতেন। এইভাবে, পবিত্র দিনগুলি বিশাল বাণিজ্যিক কার্যকলাপের সময় হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে, মন্দিরগুলি যে জমিতে অবস্থিত ছিল তা মেলার মাঠ হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র প্রদর্শনী ও আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থাসহ পণ্য বিক্রয়ের জন্য যে লোক সমাবেশ ঘটে তাকে মেলা বলে। মেলাকে পর্যাবৃত্ত বাজারের পরিপূরক বলা চলে। মেলার সাথে পর্যাবৃত্ত বাজারের পার্থক্য রয়েছে। মেলা দীর্ঘদিনের ব্যবধানে বসে এবং এর অর্থনৈতিক কার্যক্রমে আঞ্চলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মেলা ও পর্যাবৃত্ত বাজারের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য থাকলেও মেলার সূচনা, বিকাশ, পণ্যের বৈশিষ্ট্য, সংঘটনের মধ্যে ব্যবধান, পরিসর, চাহিদা ইত্যাদি পর্যাবৃত্ত বাজার থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। মেলার বাণিজ্যিক পরিসর বা পরিসীমা, মেলার পণ্যের বৈশিষ্ট্য এবং অনুষ্ঠানের তাৎপর্য অনুযায়ী বিভিন্ন হয়ে থাকে। তবে সাধারণত মেলায় বিশেষ পণ্যদ্রব্য বেচাকেনা হয় বলে অনেক দূরবর্তী স্থান থেকে ক্রেতারা মেলায় আসে। এই বিশেষত্বের কারণেই মেলার বাণিজ্যিক পরিসীমা অনেক বিস্তৃত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের মেলা বাংলাদেশের লৌকিক উৎসব হিসেবে মেলা অত্যন্ত জনপ্রিয়। অতীতে মেলা মূলত গ্রামকেন্দ্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করলেও পরে মেলা গ্রামের পরিমণ্ডল অতিক্রম করে নগর-শহরে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশে এমন কোনো জেলা নেই যেখানে বছরের নানা সময়ে গ্রামে বা শহরে মেলা বসে না। তবে কবে থেকে এবং কীভাবে এ দেশে মেলার উৎপত্তি হয়েছে তা সঠিক করে বলার উপায় নেই। গবেষকদের ধারণা, বাংলায় নানা ধরনের ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠান ও উৎসবের সূত্র ধরেই মেলার উৎপত্তি হয়েছে। সেদিক দিয়ে বাংলাদেশের মেলার প্রাচীনত্ব হাজার বছরেরও অধিক পুরনো। এদেশের প্রাচীন পর্যায়ের উৎসব ও কৃত্যানুষ্ঠানকেন্দ্রিক মেলাগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে জীবন ধারণের আহার্য কৃষিশস্য এবং বিশেষ করে কৃষির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রোদ ও মেঘের কথা। রোদ মানে সূর্য। প্রাচীন বাংলার মানুষ চাঁদ ও সূর্যকে বুড়া-বুড়ি নামে যেখানে পূজা করেছে, সেখানে পূজা-উৎসবে পূজারিরা সমবেত হতে থাকলে একসময় ধীরে ধীরে বুড়া-বুড়ির মেলা প্রবর্তিত হয়। এর সঙ্গে আসে মেঘের জন্য বরুণ বা বারুণী। উল্লেখ্য, বুড়া-বুড়ির মেলাটি পরে সূর্য মেলা, সূর্য ঠাকুরের ব্রত, চৈত্রসংক্রান্তির ব্রতের মেলা, চড়ক মেলা, শিবের গাজনের মেলায় রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে মেঘের দেবতা বরুণ-বারুণীস্নানের মেলা হিসেবে রূপ গ্রহণ করে।
গবেষকদের পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রাম-শহর জুড়ে প্রতিবছর এখনো পাঁচ হাজারের অধিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত প্রতিটি মেলা আয়োজনের পেছনে কোনো না কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। সেটি হয় ধর্মীয়, নয়তো ব্রত-পালা-পার্বণ অথবা যেকোনো একটি নির্ধারিত বিষয় বা ঐতিহ্যকে স্মরণ করে। মেলার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে, নির্ধারিত স্থানে নির্ধারিত তারিখ বা তিথি-লগ্নে একেকটি মেলায় নর-নারী, শিশু-কিশোর, এমনকি আবাল-বৃদ্ধরাও সমাগম ও সমাবেশ করে থাকে। তবে মেলার বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে, ব্যবহার্য পণ্য ও গৃহসামগ্রীর বিরাট সমাবেশ এবং চিত্তবিনোদনের জন্য যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচের আসর ইত্যাদি।
গ্রামীণ মেলার চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে এখন অনেক আধুনিক জিনিসপত্রেরও মেলা বসে। বিভিন্ন বহু জাতিক কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধরনের আয়োজনগুলো হয় সাধারণত শহরাঞ্চলে। যেমন মোবাইল মেলা, কম্পিউটার মেলা, আইটি মেলা, আবাসন মেলা ইত্যাদি। আবার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিজ্ঞান মেলা, বাণিজ্য মেলা, শিল্প মেলা, বই মেলা, কৃষি মেলা, স্বাধীনতা মেলা প্রভৃতি মেলার আয়োজন করা হয়।
এ দেশের প্রচলিত মেলাগুলোর প্রকৃতি বহু ধরনের। এক বাক্যে তার প্রকৃতি অনুসারে শ্রেণীকরণ দুঃসাধ্য। কিন্তু এ আলোচনার সুবিধার্থে এ দেশে প্রচলিত মেলাগুলোর একটি সরল শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। আগে বাংলাদেশের মেলার প্রায় সর্বাংশই ছিল গ্রামকেন্দ্রিক, যুগের পরিবর্তনে ধীরে ধীরে সেই চিত্র পাল্টে গিয়ে এ দেশের মেলা বর্তমানে গ্রাম ও শহর উভয় স্থানেই ছড়িয়ে পড়েছে। চারিত্র্য বিচারে এ দেশে প্রচলিত মেলাগুলো মোটামুটি সাতটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যেতে পারে। ধর্মীয় উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, কৃষি উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ঋতুভিত্তিক মেলা, সাধু-সন্তের ওরস উপলক্ষে ফকিরি মেলা, জাতীয় জীবনের বিভিন্ন বরেণ্য ব্যক্তি যেমন কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ইত্যাদির স্মরণোৎসব উপলক্ষে স্মারক মেলা, জাতীয় দিবসসমূহ উদ্যাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃৎতিক মেলা,ও বাণিজ্যিক সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয় মেলা। উল্লেখ্য, যেসব মেলার ঐতিহ্য বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রচলিত আছে এই শ্রেণিবিন্যাসে কেবল সেসব মেলাকেই বিবেচনায় আনা হয়েছে। সময়ের সাথে ভিন্ন বিবেচনায় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মেলাগুলো নতুনভাবেও পুনর্বিন্যস্ত করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মেলাই ধর্মীয় উপলক্ষে প্রবর্তিত। মুসলিম, সনাতন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী মিলে এ দেশে বসবাসরত সব সম্প্রদায়ই তাদের নিজস্ব ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠান উপলক্ষে উৎসব ও মেলার আয়োজন করে থাকে। সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা, শিবপূজা, কালীপূজা, রথযাত্রা, স্নানযাত্রা, দোলযাত্রা, জন্মাষ্টমী ইত্যাদি উপলক্ষে মেলা বসে থাকে। সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পার্বণ ও ধর্মীয় অনুষঙ্গে অনুষ্ঠিত মেলার মধ্যে রথের মেলা সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী। ঢাকার ধামরাইয়ের রথের মেলাটি প্রাচীন ও জাঁকালো। সনাতন ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গোৎসবকে উপলক্ষ করেই এ দেশে সর্বোচ্চসংখ্যক মেলা বসে। সর্বজনীন দুর্গাপূজা সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ও বর্ণাঢ্য ধর্মীয় উৎসব। ফলে দুর্গোৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলাগুলো ছড়িয়ে আছে সারা বাংলাদেশে। মুসলমান সম্প্রদায়ের উৎসবকেন্দ্রিক মেলার মধ্যে মহররমের মেলাগুলোই অধিক বর্ণাঢ্য। শিয়া মতবাদী মুসলিমরা কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকে স্মরণ করে শোভাযাত্রা বা তাজিয়া মিছিল বের করে এবং বিভিন্ন ধরনের কৃত্যাচার পালন করে থাকে। মহররমের মেলার ঐতিহ্যের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। মুসলিম সম্প্রদায়ের উৎসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত মেলার সূত্র ধরে বৌদ্ধ ধর্মের অনুষঙ্গে যুক্ত মেলার কথা বলা যেতে পারে। তাদের মেলার সংখ্যা আরো অল্প। এই মেলাগুলোর সবই প্রায় তাদের মূল অনুষ্ঠান বৌদ্ধ পূর্ণিমার সঙ্গে যুক্ত। জানা যায়, চট্টগ্রামের বিজুড়ি গ্রামের আশ্বিনী পূর্ণিমায় বসে তিন দিনের মেলা, কুমিল্লার বড়ইয়ায় মাঘী পূর্ণিমায় একদিনের মেলা বসে। সবচেয়ে বড়টি মহামুনির, যার স্থিতিকাল পুরো বৈশাখ মাস। এ দেশের বেশির ভাগ কৃষি উপলক্ষের মেলা অনুষ্ঠানের ঐতিহ্যের সঙ্গে লোকধর্মীয় কৃত্যের যোগ থাকে। যেমন, গৌষ্ঠ মেলা, নবান্ন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কার্তিক মেলা, পৌষসংক্রান্তি উপলক্ষে পৌষ মেলা, চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষের মেলা। কৃষি মেলার অন্য কয়েকটি রূপ আছে বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের কৃত্যানুষ্ঠান ও উৎসবের মধ্যে, কৃষিকেন্দ্রিক কৃত্যানুষ্ঠানের সূত্রে এ দেশের আদিবাসীরা প্রতিবছর বিজু, বৈজু বা বৈজু উৎসব মেলা এবং কারামপূজা উপলক্ষে একটি বিশেষ কৃষিভিত্তিক উৎসব ও মেলার আয়োজন করে থাকে। এ ধরনের মেলা ও উৎসবের আয়োজন স্থান হচ্ছে বাংলাদেশের বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ও বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চল। বাংলাদেশের মেলার আরেকটি শ্রেণিতে আছে ঋতুভিত্তিক জাতীয় মেলা, যেমন বসন্তবরণ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বসন্ত-উৎসব ও মেলা, বর্ষবরণ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বৈশাখী মেলা ইত্যাদি। বাংলা বর্ষবরণ বা নববর্ষ উপলক্ষে বৈশাখী মেলার চল এ দেশে বেশ পুরনো। তবে সম্প্রতি এ দেশের গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের চাহিদার প্রতি লক্ষ রেখে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা, পর্যটন করপোরেশন, বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিকল্পিত আয়োজনে বৈশাখী মেলা নতুন মাত্রা পেয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে উল্লেখযোগ্য বরেণ্য ব্যক্তি কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিকের নামে নিয়মিত স্মরণোৎসব অনুষ্ঠিত হয় এবং সে উপলক্ষেও মেলা বসে। যেমন রবীন্দ্র মেলা, ফরিদপুরের অম্বিকাপুরের জসীম মেলা, যশোরের সাগরদাঁড়ির মধুমেলা, নড়াইলের সুলতান মেলা, কুষ্টিয়ায় লালন মেলা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। দেশে নিয়মিত বইমেলারও আয়োজন হয়। বাংলা একাডেমির বইমেলাকে কেন্দ্র করে একুশের মেলা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব মেলার আয়োজন হয় এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ধামরাইয়ে রথের মেলা, মজমপুরের মেলা, নবাবগঞ্জের ধাইনগর মেলা, চরখাই কাটলা মেলা, কাটাগড়ের মেলা, চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ মন্দিরের মেলা, মাইজভান্ডারির মেলা, পটিয়ার ঠেগড়মুনির মেলা, জব্বারের বলি খেলার মেলা, বগুড়ার মহাস্থান গড়ের মেলা ও পোড়াদহের সন্ন্যাস মেলা, গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দির মেলা, পাবনার বোঁথরের চড়ক মেলা, হবিগঞ্জের মুড়াবন্দ দরবার শরীফের মেলা, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির মেলা, ফাইলা পাগলার মাজারের মেলা, রাঙামাটির পানছড়ি বৌদ্ধ মেলা, ঠাকুরগাঁও এর নেকমর্দ মেলা ও রুহিয়া আজাদ মেলা, কুমিল্লার শীতলার মেলা, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের বারুনী মেলা, নরসিংদীর শাহরানীর মেলা, শরীয়তপুরের সুরেশ্বর মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাতমোড়ার মেলা, সুন্দরবনের দুবলার চরে রাস মেলা,পঞ্চগড়ের নিরাশির মেলা, জামালপুরের জামাই মেলা, গাজীপুরের জামাই মেলা, বরিশালের বিপিনচাঁদ ঠাকুরের মেলা, তাড়াইলের মাঘী পূর্ণিমার মেলা, কমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাতিসার মেলা, মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকূল মেলা, বিক্রমপুরের রামপালের মেলা, রংপুরের সিন্দুরমতি মেলা, নেত্রকোনার চন্ডীগড় মেলা, পিরোজপুরের খারবাক মেলা, গোপীনাথপুরের দোলযাত্রার মেলা, খুলনার মোল্লার হাট মেলা, বাগেরহাটের খানজাহান আলীর মেলা, খুলনার পাইকগাছার বাজার খোলায় চৈত্রসংক্রান্তি মেলা, কপিলমুনির বারুনি মেলা, কুষ্টিয়ার মহরম মেলা ইত্যাদি।
বিশ্বে প্রায় সব দেশেই মেলা আয়োজনের সংস্কৃতি আছে। জাতিগত সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে এই মেলাগুলো হয়ত একেক দেশে একেকরকম হয়। বিদেশের মেলার সাথে আমাদের দেশীয় মেলার বিস্তর ফারাক বিদ্যমান। তবে আয়োজনে ভিন্নতা থাকলেও সব মেলারই উদ্দেশ্য এক। আর তা হলো, মানুষকে আনন্দ দেয়া। প্রতিবছর বিশ্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ও প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের মেলার একটি দিকে থাকে অনিবার্যভাবেই বিনোদনের ব্যবস্থা। যেমন নাগরদোলা, পুতুলনাচ, ম্যাজিক, সার্কাস, যাত্রা, বাউল-ফকির বা কবিগান, বায়োস্কোপ, লাঠিখেলা, কুস্তি, জারিগান ইত্যাদি। কিছু মেলাকে মাতিয়ে রাখে সঙের কৌতুক ও মশকরা, তারা স্বাধীনভাবে মেলায় ঘুরে ঘুরে রঙ্গ করে থাকে।
বাংলাদেশ মেলার দেশ হলেও গ্রামীণ মেলার সেই জৌলুস দিন দিন কমে আসছে। কমছে মেলার সংখ্যাও। আগে গ্রামাঞ্চলে বা বিভিন্ন তীর্থস্থানে আয়োজক কমিটির ব্যবস্থাপনায় যেভাবে মেলার আয়োজন হতো এখন তা অনেক ক্ষেত্রেই আর দেখা যায় না। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু দায়িত্ব পালন ছাড়া সরকারিভাবে গ্রামীণ মেলায় তেমন কোনো পৃষ্ঠপোষকতাও করা হয় না বললেই চলে। তবে আয়োজন যারাই করুক আর যেভাবেই হোক, মেলা যুগ যুগ ধরে মানুষের মাঝে মেলবন্ধন তৈরি করে। নানান ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের মধ্যে রচনা করে সেতুবন্ধন। তাই মেলা বেঁচে থাকুক চিরদিন।
লেকক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট