শুক্রবার ● ১১ নভেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » ১২ নভেম্বর হোক “উপকূল দিবস” উপকূল সুরক্ষায় জনসচেতনতা বাড়াতে “উপকূল দিবস” এর গুরুত্ব অপরিসীম
১২ নভেম্বর হোক “উপকূল দিবস” উপকূল সুরক্ষায় জনসচেতনতা বাড়াতে “উপকূল দিবস” এর গুরুত্ব অপরিসীম
প্রকাশ ঘোষ বিধান ॥
উপকূল শব্দটির কথা ভাবলে কল্পনায় ভেসে ওঠে এক বিধ্বস্ত-বিপন্ন জনপদের প্রতিছবি। যেখানে মানুষের সিমাহীন কষ্ট। বার বার হানাদেয় ঝড়-ঝাঞ্ঝা। জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিতে উপকল অঞ্চল। প্রতিবছর উপকূলে দুর্যোগ আঘাত হানছে। কখনো প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, কখনো জলোচ্ছ্বাস আবার কখনো তীব্র নদী ভঙ্গনে উপকূল হয় বিপন্ন। এর সঙ্গে লবণাক্ততা আর সমুদ্রপূর্ণ উচ্চতা বৃদ্ধিতে বদলে যায় জীববৈচিত্র্য। এর বিরুপ প্রভাবে পড়ে জনজীবনে। প্রতিবছর বহু মানুষ বাড়ী ঘর বদল করে। এভাবে বাপদাদারা ভিটে মাটি সহ বিপুল সম্পদ হারানো মানুষ আশ্রায় খোজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতি দুযোগ ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলা করে উপকূলবাসীকে টিকে থাকতে হয়। প্রকিবছর এতো ক্ষতি সত্তেও উপকূলের ঝুঁকি মোকাবেলায় কার্যকর উদ্যোগ খুবই কম। দেশের আর্থসামাজিক কর্মকান্ডে সাগর, নদী সহ উপকূলীয় অঞ্চল ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর সুন্দরবন সহ বঙ্গপোসাগর উপকূল এলাকার নদী সমূহ থেকে কয়েক কোটি টাকার মৎস্য আহরণ হচ্ছে। দেশের সামগ্রীক অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে ভিন্নমাত্রা। বাস্তবতার নিরিখে “উপকূল বাঁচলে দেশ বাঁচবে”। কেবল মাত্র সচেতনতা বৃদ্ধির মধ্যদিয়ে উপকূল অঞ্চলের ঝুঁকি অনেকটাই কমে আনা সম্ভব। এরজন্য চাই উপকূল দিবস। এ কর্মসূচি সবার মাঝে পরিবেশ ও উপকূল সুরক্ষায় তথ্য ছড়িয়ে দেবে। উপকূল সুরক্ষায় আগামী প্রজন্মকে চার পাশের পরিবেশ সংরক্ষন কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত করার সম্ভব হবে। এই প্রজন্ম যতবেশি সচেতন হবে, ঠিক ততবেশি সুরক্ষিত হবে উপকূল।
তিনটি নির্দেশকের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের উপকূল নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস, জোয়ার-ভাটার বি¯তৃতি ও লবনাক্ততার প্রভাব। ১৯টি জেলা উপকূলের আওতাভূক্ত। এরমধ্যে তিনটি জেলা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ন। এগুলো হচ্ছে যশোর, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ। বাকি ১৬ জেলাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, পূর্ব-উপকূলের ৫ জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর; মধ্য-উপকূলের ৮ জেলা বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, ঝালকাঠি, বরিশাল, চাঁদপুর, শরীয়তপুর এবং পশ্চিম উপকূলের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। প্রতিনিয়ত বহুমূখী প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে এই এলাকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। সংকট ও সমস্যা যেমন এই এলাকায় রয়েছে, তেমনি অবারিত সম্ভাবনাও রয়েছে গোটা উপকূল জুড়ে। বিপুল সংখ্যক মৎস্যজীবী সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূল গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখছে।
১২ নভেম্বর ১৯৭০ সাল উপকূলবাসীর জন্য অবিস্মরণীয় দিন। এদিন বাংলাদেশের উপকূলের উপর দিয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। যার নাম ছিল ‘ভোলা সাইক্লোন’। এই ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করে দেয় উপকূল। ৮ই নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্ট হয়। ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছায়। ওই রাতেই উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ছিল ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা। ওই সময়ে সেখানকার ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে ৭৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। একটি এলাকার প্রায় ৪৬ শতাংশ প্রাণ হারানোর ঘটনা ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। ওই ঘূর্ণিঝড়ে তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দ্বীপচরসহ বহু এলাকার ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। উপকূল অঞ্চলের বহু এলাকা বিরাণ জনপদে পরিণত হয়। সেইভয়াল কালো রাতে উপকূলীয় হাতিয়া, রামগতি, চর আব্দুল্লাহ, সন্দ্বীপ, ঢালচর, চর জব্বার, তজুমুদ্দিন, চর কচ্ছপিয়া, চর পাতিলা, কুকরী কুমড়ী, মনপুরা, চরফ্যাশন, দৌলতখাঁন, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় জলোচ্ছাসে ভাসে। প্রকৃতির থাবায় একইসঙ্গে কোটি কোটি টাকার সম্পদ সহ বাড়িঘর, স্কুল, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায়।
প্রলয়ংকরী ‘ভোলা সাইক্লোন’-এর আগে এবং পরেও উপকূলের উপর দিয়ে অনেকগুলো ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির বিচারে ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে ভয়ংকর বলে প্রমাণিত। স্বল্প পরিসরে হলেও এত বছর পরেও ওই দিবসটি পালিত হয়। দিনটিকে স্মরণ করে গণমাধ্যমসমূহ। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ’৭০-এর আগে ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন’-এ প্রায় ২ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। এরমধ্যে এক লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে। ১৫৮২ সালে খ্রীষ্টাব্দে বাকেরগঞ্জ তথা বর্তমান বরিশাল অঞ্চলে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ের কথা জানা যায়। ওই ঘূর্ণিঝড়েও ২ লাখ লোক প্রাণ হারান। ১৯৭০-এর পরের ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ছিল ভয়াবহ। এতে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর, ২০০৮ সালের ৩ মে নার্গিস, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর নিলোফার, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানুসহ বেশকিছু ছোটবড় ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে। তবে ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা অন্যকোন ঝড় অতিক্রম করতে পারেনি।
স্থানীয়, জাতীয় ও আর্ন্তজাতিকভাবে নানা দিবস রয়েছে। ডিম দিবস, হাঁটা দিবস, পরিবেশ দিবস, পাখি দিবস, পানি দিবস, শকুন দিবস, হাতি দিবস, শিক্ষা দিবস, স্বাস্থ্য দিবস, জনসংখ্যা দিবস, নারী দিবস, গ্রামীণ নারী দিবস, মানবাধিকার দিবস, ভালোবাসা দিবসসহ আরও অসংখ্যক দিবস। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গপোসাগরে চট্টগ্রাম থেকে ভোলা হয়ে সাতক্ষীরা পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯ জেলার প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বৈরিতায় বসবাস করছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপকূল সুরক্ষায় “উপকূল দিবস” সময়ের যুক্তিসংগতদাবী। ১২ নভেম্বর হোক উপকূল দিবস। ‘উপকূল দিবস’ পালনের মধ্যদিয়ে উপকূল সুরক্ষায় আগামী প্রজন্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবে। দুর্যোগ মোকাবেলায় মানুষকে অধিকতর সচেতন করে তোলা সম্ভব হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক