রবিবার ● ৪ ডিসেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » নারী ও শিশু » নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জনসচেতনতা রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে জনসচেতনতা রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
প্রকাশ ঘোষ বিধান
নারী ও মেয়েশিশু নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। যৌতুক, ধর্ষন, পারিবারিক কলহ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, হত্যা, মারধর সহ বিভিন্ন কারণে নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়। এসব অপতৎপরতার প্রবনতা দিন দিন বেড়ে চলছে। নারীদের নানা ভাবে উত্ত্যক্ত করে মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে। আর এর কারনে অনেক নারী আত্মহত্যা করছে।
২৫ নভেম্বর পালিত হয় “ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্য এলিমিনেশন এব ভয়োল্লে এগেইনষ্ট উইমেন বা আর্ন্তজাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস”। আর্ন্তজাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসের দিন থেকে আর্ন্তজাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ শুরু হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত এই প্রতিরোধ পক্ষ পালিত হয়। ১৯৬১ সালের ২৫ নভেম্বর ভোমিনিকা প্রজাতন্ত্রের তিন নারী নেতা সে দেশের তৎকালীন শাসক রাফায়েল ক্রূজিলোর নির্দেশে আততায়ীর হাতে খুন হয়। ১৯৮১ সাল থেকে নারী আন্দোলনকারীরা এই দিনটি কে স্মরণ করে আসছে। ১৯৯৩ সালে জাতি সংঘ সাধারণ পরিষদ গৃহীত নারী নির্যাতনের অবসার সংক্রান্ত ঘোষনা, নারী নির্যাতন যে মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও নারীর প্রতি এক ধরনের বৈষম্য আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি পায়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতি সংঘ সাধারণ পরিষদের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ নভেম্বরকে আর্ন্তজাতিক নারী নির্যাতন বিলোপ দিবস ঘোষনা করা হয়। বিশ্ববাসীর কাছে নারী নির্যাতনের এই দিনকে স্মরনীয় করা ও নারী নির্যাতন সমস্যা বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহনের আহ্বান জানানোই দিবসটির মূল উদ্দেশ্য।
নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েই চলছে। রাস্তা ঘাটে, হাসপাতাল, বাস-ট্যাস্কি, কার, সিনেমা হলে, টার্মিনালে, স্কুল-কলেজ সহ বিভিন্ন স্থানে নারীদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে মহিলা পরিষদের জরিপ অনুযায়ী জানুয়ারী-অক্টোবর এই ১০ মাসে মোট ৪ হাজার ১৪৪ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০১৫ সালে এক বছরে নির্যাতিত হয়েছিল মোট ৪ হাজার ৪৩৬ জন। নির্যাতিত নারীরা ধর্ষন, হত্যা, অ্যাসিডদগ্ধ, যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন, অপহরণ, বাল্যবিবাহ, আত্মহত্যা, জোর করে বিয়ে, পুলিশি নির্যাতন, উত্ত্যক্ত, ফতোয়া, পতিতালয়ে বিক্রি, পাচার সহ ৩৪ ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। গত ২০ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌতুক, পারিবারিক কলহ, ধর্ষন, আত্মহত্যা ও অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার- এই ছয়টি ধরনে মোট ১ হাজার ৮১ জন নারী বিভিন্ন নির্যাতনে আহত ও নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষিত হয়েছে ৩৪২জন নারী ও কন্যা শিশু। গনধর্ষনের শিকার হয়েছে ৬৮ এবং ধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছে ২৮ জনকে। স্বামীর হাতে খুন হয়েছে ১৫২ জন। অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে ৩০ জন। যৌতুকের কারণে খুন হয়েছে ৫৩ এবং আহত হয়েছে ৮৪ জন। ২৯২ জন নারী নানা কারণে আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে ৪৩ জন নারীর। শুধু নভেম্বর মাসে মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে জানাযায়, শিশু হত্যা ১৭ জন, আত্মহত্যা ৬৫ জন ও ধর্ষনের শিকার ৫৭ নারী। নভেম্বর মাসে দেশের সামগ্রিক নারী নির্যাতনের পরিস্থিতি আশাব্যজ্ঞক পরিবর্তন হয়নি বলে মনে করে দেশের অন্যতম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা। শিশু নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষনের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। এছাড়াও নারী ধর্ষন, খুন, নির্যাতন, পারিবারিক ও সামাজিক কন্দলে আহত ও নিহত, আত্মহত্যা, গৃহকর্মী নির্যাতন রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলি উল্লেখ যোগ্য। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট সিগমা হুদা এ বিষয়ে বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নির্বিকার আচারণ, যথাযথ দায়িত্ব পালন না করা, আসামীদের বেশীরভাগ রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী হওয়ার কারনে নারীদের ওপর সহিংসতা বাড়ছে, শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই নারী নির্যাতন বাড়ছে। ভারতের দিল্লিতে নারীরা ট্যাক্সিতেও ধর্ষনের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে আগে পাবলিক যানবাহনে নারীরা অনেকটা নিরাপদ মনে করত। কিন্তু এখন বাস, ট্রেনেও নারীর যৌন হয়নারীর শিকার হচ্ছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নারীদেরই সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সিগমা হুদা বলেন, আসামীর কাছ থেকে বড় অংকের ক্ষতিপুরণ আদায় করতে পারলে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা হলে নারী নির্যাতনের সংখ্যা কমে আসবে। (সকালের খবর ২৫ নভেম্বর)
দেশে নারী নির্যাতন আশাব্যজ্ঞক পরিবর্তন হয়নি বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে পারে। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে আইনের প্রয়োগ ও শাস্তির মাত্রা হতে হবে দৃষ্টান্তমূলক। স্কুল-কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে নৈতিকতা শিক্ষা ও মাদক এবং অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা অব্যহৃত রাখতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে মানুষের নৈতিক আচারণের পরিবর্তন, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। তবে সব কিছুর আগে মানুষের মনের ভিতরের পশুত্বতাকে দমন করে মনুষত্বাবোধকে জাগ্রত করতে পারলে নারী ও শিশুর নির্যাতন অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে।
লেখক ঃ সাংবাদিক