মঙ্গলবার ● ১ আগস্ট ২০১৭
প্রথম পাতা » সাহিত্য » আর্তমানবতার সেবায় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অবদান চিরস্মরনীয়
আর্তমানবতার সেবায় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অবদান চিরস্মরনীয়
প্রকাশ ঘোষ বিধান
জগত বিখ্যাত বিজ্ঞান আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। তিনি ছিলেন একধারে বিজ্ঞানী, শিক্ষক, শিল্পস্রষ্টা, সমাজসেবক, রাজনীতিক, সু-সাহিত্যিক সহ বহুগুনের অধিকারী এক মহান দেশপ্রেমিক। খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাড়–লী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৮৬১ সালের ২ আগষ্ট জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা হরিশ্চন্দ্র রায় ও মাতা ভূবন মোহিনী দেবী। এই মহান বিজ্ঞানী সারা জীবন দেশের কল্যাণে কাজ করে ৮৩ বছর বয়সে ১৯৪৪ সালের ১৬ জুন না ফেরার দেশে গমন করেন।
তিনি এ বিশ্বের বিস্ময়। তার কাছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পাত্র বা দেশ-কালের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। দারিদ্রের জন্য তার হস্ত সব সময় উন্মুক্ত ছিল। জাত পাতের বিরুদ্ধে তার বজ্রকণ্ঠ গর্জে উঠেছে- “আমি কোন সমাজভুক্ত নই। আমি হিন্দুর হিন্দুত্ব, মুসলমানের মুসলমানত্ব, ব্রাত্যক্ষত্রিয়ের ব্রাত্যক্ষত্রিয়ত্ব গ্রহণ করি। আমি রাসায়নিক” আমি নিক্তির ওজন করিয়া সকলের ভালো মন্দ ওজন করিয়া বিচার করিতে চাই।”
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বাঙালি জাতি তথা বিশ্বের এক গর্বিত সন্তান। বিপদগ্রস্থ ও অসহায় মানুষদের সাহায্যে দেবদূতের মতো তিনি আবিভূত হয়ে ছিলেন। তিনি আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। ১৯২১ সালে খুলনার দক্ষিণাঞ্চলের দূর্ভিক্ষের কথা সর্বজন বিদিত। ১৯১৯ ও ১৯২০ সালে পরপর ২ বছর অনাবৃষ্টির কারণে দক্ষিণ খুলনায় দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দেশময় হাহাকার, পেটে ভাত নেই, পরণে কাপড় নেই, মানুষের কঙ্কালসার দেহ, গাছে ফল নাই, এমনকি অনেক গাছেও পাতা নাই, মাছ ধরে সিদ্ধ করে খাবে তারও উপায় নেই, থাল-বিলে জল নাই। অর্ধাহারে-অনাহারে মানুষ তিলে তিলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। অসহায় মানুষ শাপলার ফুল, শালুক, কচুখেয়ে জীবন ধারণ করছে। দুর্ভিক্ষ কবলিত খুলনার দক্ষিণ মানুষের ভয়াবহতা দেখে তিনি হতবাক হন। চারিদিকে অসহায় মানুষের হাহাকার আর সিমাহীন দুর্দশা দেখে গরীবের বন্ধু এই মহামানবের অন্তরাতœা কেঁদে ওঠে। কিন্তু সরকার এ দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় কোন প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। শাসক মহলের এরূপ নিলিপ্ততা দেখে তিনি নিজেই দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় নেয়ে পড়েন। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় তারই নেতৃত্বে খুলনায় “রিলিফ কমিটির” গঠিত হন। বিশিষ্ট আইনজীবী জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোষ, কুঞ্জলাল ঘোষ, নগেন্দ্রনাথ সেন, বিনোদ ব্রহ্মচারী সহ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ এ কমিটিতে যোগদান করে দূর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সহযোগিতা করেন। দূর্ভিক্ষ মোকাবেলায় খুলনার বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মগোলা প্রতিষ্ঠা করেন। রিলিপ কমিটি সভাপতি হিসাবে দেশবাসীর দান সহযোগিতা আহ্বান করেন। তৎকালীন সরকারের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করায় খুলনার কালেকটার এল,আর ফোকাস নামের এক ইংরেজ আই, সি, এস কে দূভিক্ষের তদন্ত করতে পাঠানো হয়। তদন্তের রিপোর্টে কি হবে তা পূর্বেই তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়া হয়। তিনি নদী পথে যেতে যেতে নদীর ধারে সুন্দরবনের কেওড়া গাছ ভর্তি টক ফল দেখে পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী তদন্তের ফলাফল সরকারকে জানান। ‘গাছে ফল, ফুল পাতা ভর্তি, অতএব দুর্ভিক্ষের প্রশ্ন ওঠে না।
যখন প্রফুল্ল চন্দ্র রায় আশাশুনি নামকস্থানে ডাল, চাল, কাপড় বিতরণ করছিলেন, সেই সময় তার সংগে ফোকাসের দেখা হয়। তিনি তীব্রকণ্ঠে রিপোর্টের বিরোধিতা করে ছিলেন। জবাবে ফোকাস বলেছিলেন- ‘কি করতে পারি স্যার, আমার উপর এমনি হুকুম আছে। ড. পি সি রায় জিজ্ঞাসা করে ছিলেন Why Have you reported like that, উত্তরে ফোকাস বলেন What Can I do Sir, If it is the Policy to the Government, বাংলাদেশ মথা ভারত বর্ষে তাহার মতো অক্লান্ত কর্মি বিরল ছিল। নভেম্বর মাসে দুর্যোগ কবলিত দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সেবাযজ্ঞের কাজ শেষ হয়। উদ্বৃত থাকে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। তিনি ঐ টাকার পুনর্বাসন প্রকল্প গ্রহণ করেন।
১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর ২২ তারিখ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত প্রবল বর্ষার কারণে উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলে রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়ার অসংখ্যক গ্রাম বন্যার জলে একাকার। ঘর-বাড়ী, গরু-ছাগল, ক্ষেতের শস্য বন্যায় ভেসে যায়। সবকিছু হারিয়ে নিশ্ব মানুষের হাহাকার। বিদেশী সরকার একেবারে নিশ্চুপ। এই খবর শুনে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তার নিজ এলাকার দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার পরপরই উত্তরবঙ্গে বানভাসী মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি বন্যা দুগতি মানুষের সাহায্যের জন্য বেঙ্গলে রিলিফ কমিটি গঠন করেন। রিলিফ কমিটির সভাপতির দায়িত্বভার নিতে হয় প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে। এই কমিটি অল্প সময়ের মধ্যে কলকাতার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ ও বস্ত্র সংগ্রহ করে। এ কাজে সুভাষ চন্দ্র বসু, ড. ইন্দ্রসেন গুপ্ত, যতীন্দ্র নাথ রায় সহ প্রমুখ ব্যক্তি সক্রিয় সহযোগিতা করেন। তিনি দেশবাসী ও বিদেশীদের কাছে বন্যাদূর্গত মানুষের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করলে বিভিন্ন পেশা-শ্রেণির মানুষ ড. পিসি রায়ের হাতে প্রচুর অর্থ, বস্ত্র ও খাদ্য সামগ্রী তুলে দেয়। প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের আহবানে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যের জন্য প্রায় ৭ লক্ষ টাকা সাহায্য উঠলো। লোকে জানতো সাহায্যের টাকার একটি পয়সাও অপচয় হবে না। স্কুল- কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের টিফিন খরচ বাঁচিয়ে রিলিফ কমিটির কাছে অর্থ তুলে দেন। গৃহীত অর্থ বন্যা আক্রান্ত মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া তিনি তার বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যালস এ তৈরি ঔষধ দিয়েও বন্যার্তদের সাহায্য করেন। এরপর ১৯৩১ সালে উত্তর ও পূর্ব উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। প্রায় ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্লাবিত হয়। বন্যার প্রবল স্রোতে মানুষের সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সব কিছু হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে মানুষ। বানভাসী মানুষদের বাঁচানোর জন্য তিনি ত্রাণকর্তর ভূমিকা আবিভিত হন। বিজ্ঞান কলেজে তার বাসভবনে সংকট ত্রাণ কমিটি গঠন করা হয়। দেশ-বিদেশ থেকে পাওয়া দানসামগ্রী নিয়েই প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বানভাসী অসহায় মানুষকে সাহায্য করে তাদেরকে অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন।
বন্যা পীড়িত এলাকা পরিদর্শন করে মানব দরদী ইংরেজ মিশনারী ও রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ সুহৃদ দীনবন্ধু এনড্রুজ সংবাদপত্রে লিখলেন ঃ “বেঙ্গল রিলিফ কমিটির কাজ যতই আমি দেখিয়াছি, ততই আমি বিস্মিত হইয়াছি। দুর-দুরন্ত গ্রামেও সেবার হস্ত প্রসারিত হইতে দেখিয়াছি। বস্তুত, একথা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে, ড. পি,সি, রায় এবং তাহার সহকারীবৃন্দের উৎসাহ ও প্রেরনায় যে কাজ হইয়াছে, তা বর্তমান ভারতে মানবের দুঃখ-দুর্দাশা দুর করিবার জন্য একটি সুমহৎ প্রচেষ্টা”। রিলিফের কাজে ৬১ বছর বয়স্ক রাসায়নিকে অদ্ভুত কর্মশক্তি দেখে ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ান এর প্রতিনিধি লিখলেনঃ মিঃ গান্ধী যদি আর দুইজন স্যার পি,সি রায় তৈরি করতে পারতেন, তবে এক বৎসরের মধ্যেই তিনি স্বরাজ লাভের সক্ষম হতেন।
প্রফুল্ল চন্দ্র রায় নিজে ভালো নাখেয়ে না পরে গরীব দুঃখীদের খাইয়ে পরিয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটাতে চেয়ে ছিলেন। তিনি অতি সাধারণ জীবন যাপন করে অর্থ বাঁচিয়ে তাহা তিনি দুঃস্থদের জন্য ব্যয় করতেন। তার খাওয়ার তালিকায় ছিল সারাদিন ডাল, ভাল, তরকারি, মাছ। এছাড়া ১টা ডিম, ১ পোয়া দুধ, আর ছোট দুটো কলা। দিনে ভাত খেতেন না পাউরুটি খেতেন। এমন মানব দরদী নিঃস্বার্থবান মানুষ সমাজে সত্যি বিরল।
আচার্য সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, “১৯০৯ সালে গোখেল যখন কলকাতায় আচার্য রায়ের প্রতিবেশী ছিলেন সে সময় আমার ওর (আচার্য রায়ের) সঙ্গে আলাপের সুযোগ হয় প্রথম। আমি তখন গোখেলের অভিভাবকত্বে। এটা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে সাধারণ ভারতীয় পোশাক পরিহিত একজন মানুষ, যার আচার- ব্যবহার আরও সাধারণ, আসলে এক বড় মাপের বিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক হিসাবে ইতিমধ্যেই স্বীকৃত। আমি রূদ্ধ নিঃশ্বাসে সুনলাম যে আচার্য রায় তার রাজচিত বেতন থেকে সামান্য কিছু টাকা নিজের জন্য রেখে বাকি সবটাই জনহিতকর কাজে বিশেষ করে দরিদ্র ছাত্রদের সাহায্যদানে নিয়োজিত করতেন। ভারতের এই মহান সেবক এই তিরিশ বছরে একটুও বদলাননি। বিরামহীন সেবা, উদ্দীপনা এবং আশাবাদের যে দৃষ্টান্ত তিনি আমাদের সামনে রেখেছেন তা নিয়ে অবশ্যই আমরা গর্ব করতে পারি”। -এম কে গান্ধী যারবেদা সেন্টাল জেল পুনা ২৪ মে ১৯৩২।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন সর্বকালের একজন সাহসী খাঁটি বাঙালি। তিনি ছিলেন সর্বক্ষেত্রে উজ্জল নক্ষত্রের মতো। তিনি নিজে যে কাপড় জামা পরতেন তার পিয়নকেও সেই কাপড়ে জামা তৈরি করে দিতেন। তিনি নিজের কাপড় নিজে কাচতে ও জুতায় কালী করতে অপমান বোধ করতেন না। তিনি ভারতেন একমাত্র ‘নাইট’ যার কোন খানসামা ছিল না। তার কাছে কায়িক পরিশ্রম করা ছিল আনন্দদায়ক। তিনি স্বদেশ ও স্বজাতির কল্যাণে জীবন উৎস্বর্গ করেছেন। মানুষের কল্যাণে কাজ করাকে জীবনে ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার মহামানব ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাতের উর্দ্ধে উঠে সম্প্রতির মহাসমন্বয় ঘটিয়েছেন। তিনি ছিলেন বাঙালির বাতি ঘর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থ বলেছেন, “আচার্য নিজের জয়কীর্তি নিজে স্থাপন করেছেন উদ্যমশীল জীবনের ক্ষেত্রে, পাথর দিয়ে নয়, প্রেম দিয়ে। আচার্য প্রফুল্লা চন্দ্র রায় বাঙালির অহংকার, বিশ্বের গর্ব। তার র্কীতি বিশ্বে থাকবে চির বহমান। এ মহামানবকে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
লেখক ঃ সাংবাদিক