শনিবার ● ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » আত্মহত্যা ঃ রুখতে হবে প্রবণতা
আত্মহত্যা ঃ রুখতে হবে প্রবণতা
প্রকাশ ঘোষ বিধান
বিষন্নতা মানুষকে আত্মহত্যা প্রবণ করে তোলে। আত্মঘাতী ক্ষণিক আবেগে আত্মহত্যা, একটি জীবনের চির অবসান। নিজ হাতে নিজের জীবনকে শেষ করে দেওয়া। জীবনে এক চরম অসহায়ত্বের কাজে পরাজয়, স্বার্থপরের কাজ আত্মহত্যা। এটা কোন সমাধান হতে পারে না। আত্মহত্যা মহাপাপ। পৃথিবীর কোন ধর্মই আত্মহত্যা সমার্থন করে না।
১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। আত্মহত্যা প্রতিরোধকল্পে জনসচেতনতা বাড়াতে আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন করে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচীর মধ্যদিয়ে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১০ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসাবে স্বাক্ষর করে। এই দিনটিতে সারাবিশ্ব আত্মহত্যা বিরোধী নানা ধরণের জনসচেতনতা মূলক কর্মসূচি পালন করা হয়।
এতোসব এর পরও আত্মহত্যা থেমে নেই। কোন কারণে কোথাও কেউ না কেউ আত্মহত্যা করছে। ক্রমাগত ভাবে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, সারাবিশ্বে প্রতিলাখ মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার হার ১১.৪ শতাংশ। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১টি করে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এ হিসাবে প্রতি বছর ৮ লাখের বেশী মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। আর আত্মহত্যার অপচেষ্টা চালায় প্রায় ২ কোটি মানুষ। এর মধ্যে ৪০ লাখ কমবয়সী। আন্তর্জাতিকভাবে ১৫-১৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হলো আত্মহত্যা। ধনী দেশগুলোয় নারীর তুলনায় পুরষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশী। সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন পাঞ্চাশোর্ধ পুরুষরা। নিন্ম ও মাধ্যম আয়ের দেশে তরুণ ও বয়স্ক নারীদের মধ্য আত্মহত্যার হার বেশী। ২০২০ সাল নাগাত বিশ্বে প্রতিবছর সাড়ে ১৫ লাখ মানুষ আত্মঘাতী হবেন। আর ১০ থেকে ২০ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা চালাবেন। ডব্লিউএইচও এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন এবং বছরে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশী আত্মহত্যা করছে। এদের বেশীর ভাগ ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী। দেশে ১০ থেকে ১৪ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে এবং ৫ শতাংশ কখনো না কখনো আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। বিবাহিত নারীদের মধ্যে শহরের ১৪ শতাংশ ও গ্রামের ১১ শতাংশ নারী আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে। আশংকাজনক ভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। গত কয়েক বছরে দেশে যৌন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, মাদকাশক্তি, ইভটিজিং ও অন্যান্য কারণে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিদিন কতজন মানুষ আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টা চালায় তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তার কারণ আত্মহত্যা চেষ্টাকারীদের অধিকাংশ হাসপাতালে আসেনা এবং স্থানীয় থানাকে জানায় না।
আত্মহত্যার পিছে লুকিয়ে থাকা ৯৫ শতাংশ কারণ হয়ে থাকে মানসিক ও বাকি ৫ শতাংশ কারণ থাকে শারীরিক আঘাত বা ভিন্ন ঘটনা। আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ বিষন্নতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বের প্রায় ১২১ মিলিয়ন মানুষ মাত্রাতিরিক্ত বিষন্নতার স্বীকার। আগামী ২০২০ সালের মধ্যে হৃদরোগের পরই বিষন্নতায় মানুষের বিপন্নতার দ্বিতীয় অন্যতম কারণ হিসাবে প্রতিয়মান হবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের ৪.৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরী গুরুতর বিষন্নতা রোগে ভুগছে। আর দেশের হতাশগ্রস্থ জনগোষ্টির সংখ্যা আরো ব্যাপক। এই বিশাল সংখ্যাক জনগোষ্টি আত্মহত্যার ঝুঁকি নিয়ে ঘুড়ে বেড়ায়। হতাশাবোধ থেকে ধীরে ধীরে বিষন্নতা রোগে আক্রান্ত হয়। আর তখনই আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসে। আত্মহত্যা অন্যতম কারণগুলো হলো; যৌতুক, যৌন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন-নিপীড়ন, দাম্পত্য কলহ, উত্তাক্ত করা ও প্ররোচিত আত্মহত্যা, মাদকাশক্তি জনিত সমস্যা, দারিদ্র ও বেকারত্ব, প্রেম- ভালবাসায় ব্যর্থতা, অপছন্দের বিয়ে, পরীক্ষায় অকৃতিকার্য, রোগ যন্ত্রণা, মানসিক অবসাদ ইত্যাদি। বড় ধরণের কোন শোক যেমন, নিকট আত্মীয়, প্রিয় বন্ধু, প্রিয় অভিনেতা বা শিল্পীর আকস্মাৎ মৃত্যু সংবাদ, অপবাদ চাপিয়ে দেওয়ায় প্রচন্ড রকম হতাশা ও ক্ষভের কারণে নিজের আস্তা হারিয়ে ফেলা, ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে, প্রেমিক বা প্রেমিকা ইচ্ছা পূরণের জন্য জেদের বশবর্তী হয়ে, শখের জিনিস বা উপহার না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে দেখা যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বে কিটনাশক বা অন্যান্য বিষ, ফাঁস দিয়ে বা গুলিতে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে। দেশে আত্মহত্যার মাধ্যম হিসাবে কিটনাশক বা অন্যান্য বিষ এবং ফাঁস এর ব্যবহার বেশি হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিটনাশকে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বিষক্রিয়ার উপাদানের মাত্রা কমিয়ে আত্মহত্যার হার কমানো সম্ভব হয়েছে। দেশে বড় একটি অংশ আত্মহত্যা ঘটায় কিটনাশক পানের মাধ্যমে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে কিটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আহ্বান জানিয়েছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। ২০১৩-২০ সাল মেয়াদে ডব্লিউএইচও ১০ শতাংশ হারে আত্মহত্যা কমিয়ে আনার লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ১৭০টি সদস্যরাষ্ট্র এই ব্যাপারে অঙ্গিকারও করেছে।
আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়। আত্মহত্যার মাধ্যমে তার জীবনকে হারিয়ে ফেলা। কিন্তু তার বিরূপ প্রভাব পড়ে পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের উপর। আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য একটি সামাজিক সমস্যা। আত্মহত্যা প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের উপর জোর দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে কুসংস্কার আত্মহত্যা প্রতিরোধে বাঁধা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এই ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ডব্লিউএইচও এর প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সংবাদ মাধ্যমকে এমন ভাষা পরিহার করতে হবে, যা অন্যকে আত্মহত্যায় উৎসাহী করে তোলে। এছাড়া আত্মহত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণানাও এড়িয়ে চলতে হবে। আত্মহত্যা মানুষকে কেবল ভুল পথে পরিচালনা করে না বরং তাদের পরিবারে ও সমাজের জন্য নিয়ে আসে সীমাহীন বিপর্যয়। কেউ আত্মহত্যা করার কথা বললে অথবা আত্মহত্যার হুমকি দিলে কোন ভাবেই তাকে অবজ্ঞা করা যাবে না বরং তার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিকারে ব্যবস্থা নিতে হবে। আত্মহত্যা পুরোপুরি ঠেকানো না গেলেও আত্মহত্যার মতো পরিবেশ যাতে সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে হবে। অভিভাবকদের পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় রাখা এবং প্রত্যেক সদস্যের প্রতি যতœবান ও সচেতন থাকতে হবে। নৈতিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসনের উপর জোর দিতে হবে। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার নির্দিষ্ট লক্ষ ও উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য। মানুষের জীবনে কমবেশী দুঃখ-কষ্ট থাকবে। এসব দুঃখ-কষ্ট ও বাঁধা-বিঘœ অতিক্রম করার মানসিকতা তৈরী করতে হবে। আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে এমন মানুষদের সময়মত চিকিৎসা করতে হবে। আত্মহত্যা করা বোকামী, তাদের স্বরণ করে দিয়ে অসহায় বিভ্রান্ত মানুষগুলোকে শোধরাতে পারলে তবেই আত্মহত্যা নামক অভিশাপ থেকে তাদের প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
লেখক ঃ সাংবাদিক।