মঙ্গলবার ● ৩১ অক্টোবর ২০১৭
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » রাস মেলায় যেতে উপকূল এলাকায় ব্যাপক প্রস্তুতি; তৎপর হরিণ শিকারীরা
রাস মেলায় যেতে উপকূল এলাকায় ব্যাপক প্রস্তুতি; তৎপর হরিণ শিকারীরা
প্রকাশ ঘোষ বিধান, পাইকগাছা।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে ২ নভেম্বর হতে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ৩ দিন ব্যাপী সুন্দরবনের দুবলারচরে ঐতিহ্যবাহী রাস পূর্ণিমা পুণ্যøান অনুষ্ঠিত হবে। রাস পূর্ণিমার পূণ্যøানে অংশগ্রহণ করতে উপকূল অঞ্চলের পূর্ণার্থী, তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের মধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। সুন্দরবনে প্রবেশে কড়াকড়ির মধ্যেও রাস পূর্ণিমার মেলাকে ঘিরে শিকারীদের হরিণ নিধনের প্রস্তুতিও চলছে। সুন্দরবন সংলগ্ন উপজেলার শিকারীরা রাসমেলার আড়ালে হরিণ শিকারের জন্য ফাঁদ, জাল, বরশি সহ বিভিন্ন উপকরণ তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছে।
সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক শিকারী চক্র সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী শিকারে সক্রিয় রয়েছে। এসব শিকারী চক্র হরিণ নিধনের পর মাংস, চামড়া, হাঁড়, শিং বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। লন্ডন ভিত্তিক ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাষ্ট অফ বাংলাদেশ ও জুলজিক্যাল সোসাইটির তথ্য মতে সুন্দরবনে বছরে প্রায় ১০ হাজারের বেশী হরিণ শিকারীদের হাতে মারা পড়ে। সুন্দরবনের বন বিভাগের হিসাব মতে সুন্দরবনের বাংলাদেশের অংশে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার চিত্রা হরিণ রয়েছে। বনের আয়তন খাদ্য, ও পরিবেশের উপর এর সংখ্যা নির্ভর করে। প্রতিবছর কয়েক হাজার হরিণ মারা পড়ে। আবার কয়েক হাজার হরিণ জন্ম নেয়। সুত্রমতে ৮/১০ বছরের ব্যাবধানে বনে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হরিণ বৃদ্ধি পেয়েছে। হরিণ শিকারী চক্রের দৌরত্ব আশংখাজনক ভাবে বেড়ে যাওয়ায় পরিবেশবিদরা ধারণা করছেন, সারা বছর সুন্দরবনে শিকারী চক্রের হাতে যে পরিমাণ হরিণ শিকার হয় রাসমেলার সুযোগে সেই সমপরিমাণ হরিণ শিকারের আশংখা রয়েছে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের শিকারী চক্র বার বার আটক হলেও আইনের ফাক ফোকর দিয়ে মুক্তি পাওয়ায় শিকারী চক্রের তৎপরতা বেড়ে গেছে। অভিনব কায়দায় তারা হরিণ শিকার করে। শিকারী সুত্রে জানা গেছে, লাইলনের তৈরী ফাদ,জাল পেতে, স্পিং বসানো ফাঁদ, বিষটোপ, তীর, গুলি করে, কলার মধ্যে বরশি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা ফাঁদ ও ঘাস পাতার উপর চেতনা নাশক ঔষধ দিয়ে হরিণ নিধন করা হয়। ফাঁদ পেতে শিকারীরা লাঠি নিয়ে আশে পাশে লুকিয়ে থাকে। হরিণ ফাদে আটকা পড়লে তারা ছুটে গিয়ে হরিণকে বেধড়ক পেটাতে থাকে। এক পর্যায়ে হরিণ দুর্বল হয়ে পড়ছে নৌকায় করে সুবিধামত স্থানে বা মাটির গর্তে লুকিয়ে রাখে। পরে সময় ও চাহিদামত হরিণ জবাই করে মাংস, চামড়া, শিং ও হাঁড় ক্রেতাদের কাছে পৌছে দেয়। রাসমেলাকে সামনে রেখে পেশাদার শিকারীরা বনজীবী সেজে বন বিভাগ থেকে মাছ ও কাঁকড়া ধরার পাশ মারমিট নিয়ে মেলা শুরুর পুর্বেই হরিণ শিকারের উ্পকরণ নিয়ে বনের মাঝে লুকিয়ে রেখে আসে। রাস মেলা উপলক্ষ্যে ব্যাপক নিরাপত্তা গ্রহণ করা হলেও শ্যামনগর, কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, মংলা, রামপাল, সহ উ্পকুলীয় এলাকার শিকারীরা মেলা শুরু হওয়ার ১০/১৫ দিন আগে বনের মধ্যে প্রবেশ করে রেখে আসা শিকারী উ্পকরণ দিয়ে হরিণ শিকার করে। আবার রাস মেলা শুরু হলে বিশেষ কায়দায় উ্পকরণ নিয়ে যাওয়া শিকারীরা তীর্থ যাত্রীদের সাথে একত্রিত হয়ে মিশে যায়। মেলার আনন্দে মেতে উঠা দর্শনার্থী ও নিরাপত্তা কর্মীদের চোখ ফাকি দেয় এ ফাদ দিয়ে হরিণ নিধন যজ্ঞে মেতে উঠে। রাসমেলার সময় হিরণপয়েন্ট, দুর্বারচর আলোর কোল সহ বিভিন্ন চর ও সুন্দরবন সাগর মোহনায় পুর্ণার্থী, দর্শনার্থী ও পর্যাটক সহ লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে। এ সময় জনসমুদ্রে শিকারী চক্র মিশে গিয়ে চোখ ফাকি দিয়ে হরিণ নিধনে মেতে উঠে। ব্যাপক নজরদারী থাকা স্বত্বেও শুধুমাত্র হরিণ শিকারের উদ্দেশ্যে এ বিশাল মেলায় দর্শনার্থীরুপে আগত শিকারীদের কোনভাবে আটকে রাখা সম্ভব হয় না।
পূণ্যøানে নিরাপদে যাতায়াতের জন্য দর্শনার্থী ও তীর্থযাত্রীদের জন্য সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ আটটি পথ নির্ধারণ করেছে। এ সকল পথে বন বিভাগ, পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টকার্ড বাহিনীর টহল দল তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়জিত থাকবে। অনুমোদিত আটটি পথ হলো বুড়িগোয়ালিনী, কোবাদক থেকে বাটুলানদী-বলনদী-পাটকোষ্টা হয়ে হংসরাজ নদী হয়ে দুবলারচর। কদমতলা হতে ইছামতি নদী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাগাদোবেকী হয়ে দুবলার চর। কয়রা, কাশিয়াবাদ, খাসিটানা, বজবজা হয়ে আড়–য়া শিবসা-শিবসানদী-মরজাত হয়ে দুবলার চর। কৈখালী স্টেশন হয়ে শিবসা-মরজাত নদী হয়ে দুবলার চর। ঢাংমারী/চাঁদপাই স্টেশন হয়ে পশুর নদী দিয়ে দুবলার চর, বগী-বলেশ্বর-শুপতি স্টেশন-কচিখালী-শেলারচর হয়ে দুবলার চর। শরণখোলা স্টেশন- সুপতি স্টেশন-কচিখালী-শেলার চর হয়ে দুবলার চর। দর্শনার্থী ও তীর্থযাত্রীরা ২ হতে ৪ নভেম্বর এ তিন দিনের জন্য অনুমতি প্রদান করা হবে এবং প্রবেশের সময় এন্ট্রি পথে নির্দিষ্ট ফি প্রদান করতে হবে। যাত্রীরা নির্ধারিত রুটের পছন্দমতো একটি মাত্র পথ ব্যবহারের সুযোগ পাবেন এবং দিনের বেলায় চলাচল করতে পারবেন। বনবিভাগের চেকিং পয়েন্ট ছাড়া অন্য কোথাও নৌকা, লঞ্চ বা ট্রলার থামানো যাবে না। প্রতিটি ট্রলারের গায়ে রং দিয়ে বিএলসি/সিরিয়াল নম্বর লিখতে হবে। পূণ্যার্থীদের সুন্দরবনে প্রবেশের সময় জাতীয় পরিচয় পত্র অথবা ইউপি চেয়ারম্যানের নিকট হতে প্রাপ্ত সনদপত্র সাথে রাখতে হবে। পরিবেশ দূষণ করে এমন বস্তু, মাইক বাজানো, পটকা ও বাজি ফোটানো, বিস্ফোরক দ্রব্য, দেশীয় যে কোন অস্ত্র এবং আগ্নেয়াস্ত্র বহন থেকে যাত্রীদের বিরত থাকতে হবে। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ বশিরুল-আল-মামুন স্বাক্ষরিত পত্রে এ সকল তথ্য জানানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, প্রতি বছর রাস মেলার সময় কয়েক হাজার হরিণ নিধনের আশংকা থাকে। তাছাড়া প্রতিনিয়ত হরিণ নিধন হচ্ছে। এভাবে হরিণ নিধন হলে হরিণের সংখ্যা আশংখাজনক হারে হ্রাস পাবে। এরফলে বিপন্ন হবে সুন্দরবনের চিত্রাহরিণ। বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন হারাবে তার ঐতিহ্য।