শনিবার ● ১১ নভেম্বর ২০১৭
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » ১২ নভেম্বর হোক “উপকূল দিবস”
১২ নভেম্বর হোক “উপকূল দিবস”
প্রকাশ ঘোষ বিধান।
১২ নভেম্বর উপকূলবাসীর কান্না ঝরানো বেদনা বিধুর দিন। বাঙালী জাতি আজও সেই দিনের কথা ভুলতে পারেনি। ১২ নভেম্বর ১৯৭০ সাল উপকূলবাসীর জন্য অবিস্মরণীয় দিন। এদিন বাংলাদেশের উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যায় সব চেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। যার নাম ছিল ‘সাইক্লোন ভোলা’। এই ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করে দেয় উপকূল। ৮ই নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্ট হয়। ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছায়। ১২ নভেম্বর রাতে উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ¡াসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। ১০ নং মহাবিপদ সংকেতের বার্তা মানুষের কাছে ঠিকমত না পৌছানোর কারণে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে। বেসরকারী হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা ১০ লাখের উপরে ছিল। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ছিল ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা। ওই সময়ে সেখানকার ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে ৭৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। একটি এলাকার প্রায় ৪৬ শতাংশ প্রাণ হারানোর ঘটনা ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। ওই ঘূর্ণিঝড়ে তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দ্বীপচর সহ বহু এলাকার ঘর-বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। উপকূল অঞ্চলের বহু এলাকা বিরাণ জনপদে পরিণত হয়। সেই ভয়াল কালো রাতে উপকূলীয় হাতিয়া, রামগতি, চর আব্দুলাহ, স›দ্বীপ, ঢালচর, চর জব্বার, তজুমুদ্দিন, চর কচ্ছপিয়া, চর পাতিলা, কুকরী কুমড়ী, মনপুরা, চরফ্যাশন, দৌলতখাঁন, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় জলোচ্ছাসে ভাসে। মহাপ্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসে কোটি কোটি টাকার সম্পদ সহ বাড়িঘর, পশু-পাখি, ফসলের ক্ষেত, স্কুল, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায়।
প্রলয়ংকরী ‘সাইক্লোন ভোলা’- এর আগে এবং পরেও উপকূলের উপর দিয়ে অনেকগুলো ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির বিচারে ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে ভয়ংকর বলে প্রমাণিত। জাতিসংঘ বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সংগঠিত ঘূর্ণিঝড়কে পৃথিবীর ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঝড় হিসাবে ঘোষণা করেছে। চলতি বছরের ১৮ মে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়ার সংস্থা (ডব্লিউএমও) বিশ্বর ৫ ধরণের ভয়াবহ প্রাণঘাতী আবহাওয়া ঘটনার শীর্ষ তালিকা প্রকাশ করে। তালিকার শীর্ষে প্রাণঘাতী ঘটনা হিসাবে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই ঝড়টিকে পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী হিসাবে উলেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালে ১২ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান) উপকূল অঞ্চলে সর্বকালের প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝটি আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়টির নাম ছিল ‘সাইক্লোন ভোলা’। সরকারী হিসাবে এতে তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষ মারা যায়। তবে বেসরকারী হিসাব মতে মৃত্যুর সংখ্যা দশ লাখের উপরে ছিল।
এত বছর পরেও স্বল্প পরিসরে হলেও ওই দিবসটি পালিত হয়। দিনটিকে স্মরণ করে গণমাধ্যমসমূহ। এবার প্রথম বারের মত উপকূলের ১৫ জেলার ৩২ উপজেলার ৩৪ স্থানে উপকূল দিবস পালিত হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ’৭০-এর আগে ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন’-এ প্রায় ২ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। এরমধ্যে এক লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে। ১৯৭০-এর পরের ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ছিল ভয়াবহ। এতে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর, ২০০৮ সালের ৩ মে নার্গিস, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর নিলোফার, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানুসহ বেশকিছু ছোটবড় ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে। তবে ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা অন্যকোন ঝড় অতিক্রম করতে পারেনি।
উপকূল শব্দটির কথা ভাবলে কল্পনায় ভেসে ওঠে এক বিধ্বস্ত-বিপন্ন জনপদের প্রতিছবি। যেখানে মানুষের সিমাহীন কষ্ট। বার বার হানাদেয় ঝড়-ঝাঞ্ঝা। জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিতে উপকল অঞ্চল। প্রতিবছর উপকূলে দুর্যোগ আঘাত হানছে। কখনো প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, কখনো জলোচ্ছ¡াস আবার কখনো তীব্র নদী ভঙ্গনে উপকূল হয় বিপন্ন। এর সঙ্গে লবণাক্ততা আর সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বদলে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। এর বিরুপ প্রভাবে পড়ে জনজীবনে। প্রতিবছর বহু মানুষ বাড়ী ঘর বদল করে। এভাবে বাপদাদার ভিটেমাটি সহ বিপুল সম্পদ হারানো মানুষ আশ্রায় খোজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতি দুযোগ ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াস মোকাবেলা করে উপকূলবাসীকে টিকে থাকতে হয়। প্রকিবছর এতো ক্ষতি সত্তেও উপকূলের ঝুঁকি মোকাবেলায় কার্যকর উদ্যোগ খুবই কম। দেশের আর্থসামাজিক কর্মকান্ডে সাগর, নদীসহ উপকূলীয় অঞ্চল ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর সুন্দরবন সহ বঙ্গপোসাগর উপকূল এলাকার নদী সমূহ থেকে কয়েক কোটি টাকার মৎস্য আহরণ হচ্ছে। দেশের সামগ্রীক অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে ভিন্নমাত্রা। বাস্তবতার নিরিখে “উপকূল বাঁচলে দেশ বাঁচবে”। কেবল মাত্র সচেতনতা বৃদ্ধির মধ্যদিয়ে উপকূল অঞ্চলের ঝুঁকি অনেকটাই কমে আনা সম্ভব। এরজন্য চাই উপকূল দিবস। এ কর্মসূচি সবার মাঝে পরিবেশ ও উপকূল সুরক্ষায় তথ্য ছড়িয়ে দেবে। উপকূল সুরক্ষায় আগামী প্রজন্মকে চারপাশের পরিবেশ সংরক্ষন কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব হবে। এই প্রজন্ম যতবেশি সচেতন হবে, ঠিক ততবেশি সুরক্ষিত হবে উপকূল।
তিনটি নির্দেশকের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের উপকূল নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস, জোয়ার-ভাটার বি¯তৃতি ও লবনাক্ততার প্রভাব। ১৯টি জেলা উপকূলের আওতাভূক্ত। এরমধ্যে তিনটি জেলা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ন। এগুলো হচ্ছে যশোর, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ। বাকি ১৬ জেলাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, পূর্ব-উপকূলের ৫ জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও ল²ীপুর; মধ্য-উপকূলের ৮ জেলা বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, ঝালকাঠি, বরিশাল, চাঁদপুর, শরীয়তপুর এবং পশ্চিম উপকূলের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। প্রতিনিয়ত বহুমূখী প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে এই এলাকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। সংকট ও সমস্যা যেমন এই এলাকায় রয়েছে, তেমনি অবারিত সম্ভাবনাও রয়েছে গোটা উপকূল জুড়ে। বিপুল সংখ্যক মৎস্যজীবী সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূল গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখছে।
স্থানীয়, জাতীয় ও আর্ন্তজাতিকভাবে নানা দিবস রয়েছে। ডিম দিবস, হাঁটা দিবস, পরিবেশ দিবস, পাখি দিবস, পানি দিবস, শকুন দিবস, হাতি দিবস, শিক্ষা দিবস, স্বাস্থ্য দিবস, জনসংখ্যা দিবস, নারী দিবস, গ্রামীণ নারী দিবস, মানবাধিকার দিবস, ভালোবাসা দিবসসহ আরও অসংখ্যক দিবস। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গপোসাগরে চট্টগ্রাম থেকে ভোলা হয়ে সাতক্ষীরা পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯ জেলার প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বৈরিতায় বসবাস করছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপকূল সুরক্ষায় “উপকূল দিবস” সময়ের যুক্তিসংগতদাবী। ১২ নভেম্বর হোক উপকূল দিবস। ‘উপকূল দিবস’ পালনের মধ্যদিয়ে উপকূল সুরক্ষায় আগামী প্রজন্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবে। দুর্যোগ মোকাবেলায় মানুষকে অধিকতর সচেতন করে তোলা সম্ভব হবে।