বুধবার ● ৩ জানুয়ারী ২০১৮
প্রথম পাতা » বিবিধ » মাগুরার ১০ গ্রামের ৬০ ফুলশোলা পরিবারে চলছে কোটি টাকার শিল্প সামগ্রী তৈরীর ব্যস্ততা
মাগুরার ১০ গ্রামের ৬০ ফুলশোলা পরিবারে চলছে কোটি টাকার শিল্প সামগ্রী তৈরীর ব্যস্ততা
মাগুরা প্রতিনিধি :
মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার শতপাড়া, সান্দরা, শ্রীপুর উপজেলাধীন বরালদাহ, সদর উপজেলার দরিমাগুরা, বাটাজোড়সহ ১০ টি গ্রামে ফুলশোলার বিভিন্ন দৃষ্টি নন্দন সামগ্রী তৈরী করে করে জীবিকা অর্জন করছেন অন্তত ৬০ টি পরিবার। যাদের মধ্যে শতপাড়ার শংকর মালাকার ফুলশোলা শিল্পে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। ভূষিত হয়েছেন বিসিকসহ বেশকিছু সম্মাননা পদকে। এই শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত কারুশিল্পীরা এটিকে পেশা হিসাবে আকড়ে ধরে পার করেছেন কমপক্ষে ৪ পুরুষ। বর্তমানে হয়েছে বানিজ্যিকভাবে ব্যাপক সফল। প্রতিটি পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা। প্রতিমাসে পরিবার প্রতি আয় হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। বর্তমানে সারা বছরই এসব পরিবারে চলে ব্যাপক ব্যস্ততা।
শালিখার শতপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শংকর মালাকারসহ ৬টি পরিবারের পুরুষ,নারী ও ছেলে মেয়েরা নিজেদের পুরোপুরি সম্পৃক্ত করেছেন শোলা শিল্পের সাথে । শংকর মালাকারসহ আরো অনেকের সাথে আলাপ করে জানা যায়, তাদের পূর্বপুরুষদের কাছেই শিখেছেন শোলাশিল্পের এই কারুকাজ। তার পুর্বপুরষ ফুলশোলাকেই জীবিকার উপকরণ হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। এমনকি তার পর্বের ৩ পুরুষের পেশা ছিল এই শিল্প। শংকর মালাকারের কাছ থেকে এই কাজ শিখেছেন তার স্ত্রী নিশা রাণী মালাকার, চাচাতো ভাই অমল মালাকার ও তার স্ত্রী ঝর্ণা রাণী মালাকার, পুত্র নিখিল মালকার ও তার স্ত্রী মিতালী রাণী মালাকার , নিমাই মালাকার ও তার স্ত্রী কল্পনা রাণী মালাকার, পুত্র রামপ্রসাদ মালাকার ও স্ত্রী দিপালী রাণী মালাকার, জামাতা রতন মালকার ও তার পরিবারের অপর দুইজন নারীসদস্য। বংশানুক্রমে এই কাজ শিখে পড়াশোনার পাশাপাশি মা-বাবাকে সাহায্য করছে রতœা মালাকার ও লক্ষী মালাকারসহ আরো অনেক স্কুল ও কলেজ পড়–য়া ছাত্রীরা।
শোলা শিল্পিরা আরো জানান, বৈশাখ মাসের শেষের দিকের বর্ষণে ফুল শোলার বীজ বপন করা হয় অথবা এমনিতেই চারা গজাতে থাকে ডোবা জমি কিংবা ধানি জমিতে। মাগুরা জেলাধীন শ্রীপুর উপজেলাধীন বেনিপুরের মাঠ, শালিখা উপজেলার আড়পাড়ার কালার বিল, শালিখার বগনাল বিল ও হিজলিবিল এবং সদর উপজেলার পলিতা গ্রামের কাতলামারি বিল ও কা-বাশের বিলে প্রচুর পরিমানে ফুলশোলা জন্মায়। কোন কোন চাষি তাদের ধানের ক্ষেতে ফুল শোলার চাষ করে থাকেন। প্রতি বোঝা শোলা দু’শ থেকে পাঁচ’শ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতি বোঝায় ২০০ থেকে ২৫০ পিচ শোলা থাকে। ভাদ্র্র-কার্তিক মাস পর্যন্ত ফুল শোলার মৌসুম। বিল থেকে শোলাগুলো উঠিয়ে এনে প্রথমে শোকানো হয়। তারপর মালাকার সম্প্রদায়ে প্রচলিত যন্ত্র কাইত (ছুরি) দ্বারা শুকনো শোলাগুলো ছেদন করতে হয়। ছেদকৃত শোলাটুকরোগুলো কাইত (ছুরি) দ্বারা উপরস্থ বাকল পরিস্কার করা হয়। কাইতই ফুলশোলা কর্তনের প্রধান অস্ত্র। কাজের ধরণ অনুযায়ী বড়-মাঝারি-ছোট ৩ আকৃতির কাইত রয়েছে। কাইত দ্বারা ফুল শোলাকে আড়াআড়ি করে কাগজের মতো করে ছেদন করতে হয় যাকে মালাকার সম্প্রদায় কাপ বলে থাকে। এই কাপ থেকে বিভিন্ন ডিজাইনের উপকরণ তৈরি করা হয়। কদমফুল তৈরি করার ক্ষেত্রে ফুলশোলার ছেদনকৃত টুকরাগুলোকে কদমফুলের শলাকার মতো করো চেরা হয়। কাপ দ্বারা বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করতে তুলোর সুতা পাটের সুতা ব্যবহার করা হয়। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী রঙ করা হয়। শোলার কারুকাজের উপকরণ তৈরি করতে অন্যান্য যন্ত্র বা বিষায়াদির মধ্যে রয়েছে কাঁইচি, বালিধারা, পিঁড়ি, রঙ, ময়দা, তুঁতে প্রভৃতি। ফুলশোলা দ্বারা তৈরিকৃত উপাদানের মধ্যে রয়েছে বিয়ের ফুল, পূজার ফুল, বিয়ের টোপর, হাতপাখা, বেলিফুলের কুঁড়ি, বেলিমালা, কালি প্রতিমার মালা, কদমফুল, গোলাপফুল, গোলাপের তোড়া, হ্যাট, মুখোশ, বানর, কবুতর, কাকাতুয়া ও বিভিন্ন রকম খেলনা।
ফুল শোলার তৈরি উপকরণ মাগুরার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত লক্ষীপূজা, কালিপূজা, মনসাপূজায় চাহিদামাফিক ফুল সরবরাহ করেন শংকর মালাকারের পরিবার । এছাড়াও তিনি ঢাকাস্থ নিউমার্কেট, শ্যাওড়াপাড়া, জুরাইনে এ সব উপকরণ সরবরাহ করেন। অংশ নেন বাংলা একাডেমির বৈশাখীমেলা, নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁও ফাউন্ডেশেনের মাস ব্যাপী মেলা,বিসিক মেলাসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মেলায়। এসব মেলায় অংশ নিয়ে শংকর মালাকার ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমীর বিসিক মেলায় পেয়েছেন কারুগৌরবের পদক।