রবিবার ● ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
প্রথম পাতা » ইতিহাস ও ঐতিহ্য » চারণকবি বিজয় সরকারের মৃত্যুর ৩২ বছরেও গড়ে ওঠেনি স্মৃতি সংগ্রহশালা ॥ ছাপা হয়নি গানের স্বরলিপি
চারণকবি বিজয় সরকারের মৃত্যুর ৩২ বছরেও গড়ে ওঠেনি স্মৃতি সংগ্রহশালা ॥ ছাপা হয়নি গানের স্বরলিপি
ফরহাদ খান, নড়াইল।
চারণকবি বিজয় সরকারের মৃত্যুর ৩২ বছরেও গড়ে ওঠেনি স্মৃতি সংগ্রহশালা। অযতœ-অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কবির ব্যবহৃত খাট, পাদুকা, পাঞ্জাবিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র। এমনকি কবিকণ্ঠের গানও সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। এদিকে, এখনো পর্যন্ত ছাপা হয়নি বিজয় সরকারের গানের স্বরলিপি। এতে গান বিকৃত হওয়ার পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরা বিজয় সরকারের গান চর্চা করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন তারা। আর কবির জীবদ্দশা থেকে শুরু করে মৃত্যুর পর কয়েক যুগ অতিবাহিত হলেও তার বাড়িতে যাতায়াতের রাস্তাটি এখনো পাঁকা হয়নি। অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে একুশে পদকপ্রাপ্ত চারণকবি বিজয় সরকারের বসতভিটাটিও। এছাড়া নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যে ‘বিজয় মঞ্চ’টি ভেঙ্গে নষ্ট হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে জেলা পরিষদের অর্থায়নে প্রায় সাত লাখ টাকা ব্যয়ে বিজয় সরকারের জন্মভূমি নড়াইল সদরের ডুমদি গ্রামে ‘বিজয় মঞ্চ’ নির্মাণ করা হলেও চার বছর আগেই ভবনের টাইলস ও জানালা ভেঙ্গে গেছে। ফাটল ধরেছে পিলার ও দেওয়ালে। কোনো তত্ত্বাবধায়ক না থাকায় অযতœ-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে এই স্থাপনা। পরিচর্যার অভাবে বিজয় মঞ্চের ভেতরে রাখা কবির ব্যবহৃত খাটসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ডুমদি গ্রামে এবং কবির বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছালেও নেই টিউবওয়েল ও টয়লেট ব্যবস্থা।
ডুমদি গ্রামের শাহিদা খানম বলেন, দুর-দুরান্ত থেকে ভক্তরা বিজয় সরকারের বাড়ি দেখতে আসেন। কিন্তু, কাঁচা রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। যাতায়াতে সীমাহীন কষ্ট হয়। শরিফুল ইসলাম বলেন, অবহেলিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বিজয় সরকারের বসতভিটা। পর্যটকরা এসে হতাশ হন। নড়াইল সদরের আউড়িয়া গ্রামের আহাদুজ্জামান বলেন, ডুমদি গ্রামে কবির বাড়িতে এসে তার সম্পর্কে জানার কোনো উপাদান ও পরিবেশ নেই। লিঙ্কন বলেন, বিজয় সরকার সম্পর্কে কোনো বই-পুস্তক নেই। কোনো স্মৃতিচিহৃ নেই। বিজয় সংসদের সদস্য নড়াইল প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি সুলতান মাহমুদ বলেন, নড়াইলের আনাচে-কানাচে তথা দেশ-বিদেশে বিজয় সরকারের গানচর্চা হলেও স্বরলিপির অভাব রয়েছে। তার গান ও সুর সংগ্রহ করে স্বরলিপি প্রকাশের দাবি জানাচ্ছি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে। যাতে করে বিজয়গীতির সুর কেউ যেন বিকৃত করে প্রকাশ করতে না পারেন। এছাড়া ডুমদিতে ‘বিজয় সরকার স্মৃতি সংগ্রহশালা ও গান একাডেমি’ নির্মাণের জোর দাবি জানাচ্ছি। চিত্রশিল্পী বলদেব অধিকারী বলেন, বিজয় সরকারের গান অবলম্বনে ৫০টি ছবি এঁকেছি। তার সুরের মূর্ছনা রঙতুলির মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছি। বিজয় সরকারের গানের মর্মকথা তুলে ধরেছি। তবে, বিজয় সরকারের স্মৃতি সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। চারণকবি বিজয় সরকার ফাউন্ডেশনের যুগ্ম-আহবায়ক এসএম আকরাম শাহীদ চুন্নু বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বিজয় সরকারের অবদান রয়েছে। তিনি কবিগান গেয়ে যে টাকা উর্পাজন করতেন, তা মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করতেন। তাই ‘কণ্ঠযোদ্ধা’ হিসেবে বিজয় সরকারকে ‘স্বাধীনতা পদক’ দেয়ার দাবিসহ জাতীয় চারণকবির স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানাচ্ছি।
এছাড়া বিজয় সরকারের নামে নড়াইলে ফোকলোর ইন্সটিটিউট নির্মাণসহ পাঠ্যপুস্তকে কবির রচনা ও জীবনী অন্তর্ভূক্ত করা হোক। জেলা প্রশাসক এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, বিজয় সরকারের বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণসহ তার স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া বিজয় সরকারের বাড়িতে যাতায়াতের রাস্তাটিও পাকাকরণের ব্যবস্থা করা হবে।
এদিকে, বিজয় সরকারের ১১৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তার জন্মভূমি নড়াইল সদর উপজেলার ডুমদি গ্রামে রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে দু’দিনব্যাপী লোকজ উৎসব শেষ হচ্ছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুরস্রষ্টা কবিয়াল বিজয় সরকার ১৯০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের নিভৃতপল্লী ডুমদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বার্ধ্যকজনিত কারণে ১৯৮৫ সালের ৪ ডিসেম্বর ভারতের হাওড়ার বেলুডে পরলোকগমন করেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কেউটিয়ায় তাকে সমাহিত করা হয়। একাধারে গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন বিজয় সরকার। এক হাজার ৮০০ বেশি গান লিখেছেন তিনি। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন। প্রকৃত নাম বিজয় অধিকারী হলেও সুর, সঙ্গীত ও অসাধারণ গায়কী ঢঙের জন্য ‘সরকার’ উপাধি লাভ করেন। গানের কথা ও সুরের মাঝে বিজয় সরকার আজো বেঁচে আছেন হাজারো মানুষের হৃদয়ে।