রবিবার ● ২৯ জুলাই ২০১৮
প্রথম পাতা » প্রকৃতি » সুন্দরবনে বৈরী পরিবেশ; বাঘের সংখ্যা কমছে
সুন্দরবনে বৈরী পরিবেশ; বাঘের সংখ্যা কমছে
প্রকাশ ঘোষ বিধান
২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস। প্রথম বিশ্ব বাঘ দিবস পালিত হয় ২০১০ সালে রাশিয়া সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে। বাঘ সমৃদ্ধ ১৩টি দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের সম্মেলনে বাঘ সংরক্ষণকে বেগবান করতে একটি ঘোষণাপত্র তৈরী করা হয়। এই সম্মেলন থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এই ঘোষণা পত্রের আলোকে প্রতিবছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য বাঘ সংরক্ষণ করা এবং বাঘ সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলা। বাঘ সুরক্ষায় বিশ্বের নানা দেশ বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়।
বিশ্বে ১৩টি দেশে এখনও বাঘ টিকে আছে। বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চিন, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, মালেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্পোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনা ও রাশিয়া’য় বাঘ রয়েছে। এক সময় বিশ্বে ৮ প্রজাতির বাঘের পদচারনা ছিল সর্বত্র। প্রজাতিগুলো হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সাইবেরিয়ান বাঘ, ইন্দো চাইনিজ বাঘ, কাশিয়ান বাঘ, জাভান বাঘ, সুমাত্রান বাঘ, দক্ষিন চীনা বাঘ ও বালি বাঘ। এর মধ্যে বালি বাঘ, জাভান বাঘ ও দক্ষিন চীনা বাঘ বিলুপ্তির পথে। ১৯০০ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ১ লাখ। বর্তমানে তা কমে দাড়িয়েছে ৩৭০০টি বা তার কম। গত এক শতাব্দীর মধ্যে প্রথম বারের মত বিশ্বে বাঘের সংখ্যা বদ্ধি পেয়েছে বলে প্রাণি সংরক্ষণবিদরা জানিয়েছেন। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড ও গ্লোবাল টাইগার ফোরাম জানিয়েছে, সর্বশেষ বিশ্ব শুমারিতে ৩ হাজার ৮৯০টি বাঘের সন্ধান পাওয়া গেছে। সর্বশেষ গণরায় দেখা গেছে, বিশ্বে মোট বাঘের অর্ধেকের ও বেশী ভারতে রয়েছে, যার সংখ্যা ২ হাজার ২শ ২৬টি। তবে ২০১০ সালে বিশ্বব্যাপী বাঘের সংখ্যা ৩ হাজার ২শ টিতে নেমে গিয়েছিল।
বিশ্বে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ বাঘের আবাসস্থল বাংলদেশের সুন্দরবনের অংশ। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বদলে যাওয়ায় বাঘের জীবন চক্র বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে বাঘ বলতে আমরা প্রধাণত সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বুঝি। বনের এই বাঘের জীবন সংকটাপন্ন। আবাস্থল নষ্ট হয়ে যাওয়া, খাদ্য সংকট ও বাঘ শিকারীদের দাপটে সুন্দরবনের বাঘ বিলুপ্তির পথে।
বন বিভাগ এনএনডিপি’র সহায়তায় প্রথম বারের মত ২০০৪ সালে বাঘের পায়ের ছাপ গণণা করে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করে ছিল ৪৪০টি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে ক্যামেরার ট্যাপিং পদ্ধতিতে বাঘ গননা করে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ১০৬টি। সুন্দরবন ভারতের অংশে ৬৪টি। বাংলাদেশ ও ভারত মিলে পুরা সুন্দরবন মিলে বাঘের সংখ্যা ১৭০টি। বন বিভাগের জরিপ দল সুন্দরবনে মোট ৩৮টি পূর্ণবয়স্ক ও ৪টি বাঘের বাচ্চার ছবি তুলতে পেরেছে। বাকী ৬৮টি বাঘের সংখ্যা নির্ধারন করা হয়েছে খালে তাদের পায়ের ছাপ গুনে ও বিচরণের অন্যান্য তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে ক্যামেরা বন্দি হওয়া ৩৮টি বাঘের ৩০ শতাংশ পুরুষ এবং বাকীগুলো নারী।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, সুন্দরবনে শিকারী চক্র বাঘ হত্যায় তৎপর আছে। তারা সুযোগ পেলে বাঘ হত্যা করে অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ বিভিন্ন দেশে পাচার করে। পশ্চিম বন বিভাগে শিকারীরা বেশী তৎপর। এ পর্যন্ত শিকারীদের হাতে কত কি বাঘ মারা পড়েছে তার হিসাব বন বিভাগের কাছে নেই। তবে বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ১৯৮০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ ৩৭ বছরে চোরা শিকারী ও বন দস্যুদের হামলা, গ্রামবাসীর গনপিটুনি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে সুন্দরবনের ৮৬টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। তবে পরিমান বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটেছে তার তুলনায় কমই হিসাবে ধরা পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করে তিন পরিস্থিতিতে বাঘ লোকলয়ে এসে হত্যার শিকার হয়। প্রথমত, বাঘ যে এলাকায় থাকে সে এলাকায় খাদ্যের অভাব। দ্বিতীয়ত, বাচ্চা বাঘ ২ থেকে আড়াই বছর বয়সে মাকে ছেড়ে আলাদা হয়ে যায়। এ সময় বাঘ তার নিজস্ব এলাকা নির্ধারনের জন্য এলাকা খুঁজতে খুজতে বনের বাইরে আসতে পারে। তৃতীয়ত, বৃদ্ধ হয়ে গেলে বা অসুস্থ হরে বাঘ তার নিজ এলাকা হারিয়ে ফেলে। আরেকটি বাঘ তার এলাকা দখল করে নেয়। তখন এই বাঘ খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে। পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগে বাঘ লোকালয়ে আসার ঘটনা বেশী ঘটে। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জানান, সুন্দরবনে সম্পদের উপর মানুষের চাপও এখন অনেক বেশি। এটি বনের সম্পদ ও প্রানীর জন্য হুমকি। বন বিভাগের জনবল খুব কম। বনের সম্পদ রক্ষায় বনকর্মী ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সব সময় তৎপর রয়েছে।
প্রাণী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা সুন্দরবনের বাঘের মৃত্যুর জন্য ৯টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায়, সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়া, মিঠাপানির অভাব, খাদ্য সংকট, বন ধ্বংস, বাঘের আবাস্থলের অভাব, চোরা শিকারীর হানা ইত্যাদি। দিন দিন বাঘের সংখ্যা কমছে। বাঘ হত্যা বন্ধ এবং জলদস্যু দমনে সরকার ট্যাক্সফোর্স ও ক্রাইম কন্টোল ইউনিট গঠন করলেও বাঘ হত্যা বন্ধ করা যাচ্ছে না। বাঘ কমলে সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্যের উপর হুমকি বাড়বে। তাই শুধু বাঘ নয়, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে রক্ষায় এবং সকল জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদের জনগনকে বন সুরক্ষায় আরো বেশী সচেতন এবং উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। আর তা না হলে বিপন্ন হবে বাংলাদেশের গৌরব বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন।
লেখকঃ সাংবাদিক