বুধবার ● ৭ নভেম্বর ২০১৮
প্রথম পাতা » ইতিহাস ও ঐতিহ্য » কাজী ইমদাদুল হক এর সাহিত্য-কীর্তি
কাজী ইমদাদুল হক এর সাহিত্য-কীর্তি
প্রকাশ ঘোষ বিধান
কবি, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঐপন্যাসিক, কিশোর লেখক কাজী ইমদাদুল হকের জন্ম খুলনা জেলার গদাইপুর গ্রামের একটি শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তার পিতা কাজী আতাউল হক ছিলেন পেশায় মুক্তার। তার আইন পেশায় মোটামুটি ভাল রোজগার ছিল। জমিজমা থেকে পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হতো। কিন্তু তাদের বিত্তের ব্যাপারে আগ্রহ কম ছিলো- বিদ্যাচর্চার উৎসাহ ছিল বেশি। সে কালের গ্রামের মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের ব্যাপারে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা ছিলো। তা সত্বও কাজী ইমদাদুল হক উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে হতোদ্যম হয়নি। প্রথমে গ্রামের স্কুল, পরে খুলনা জেলা স্কুল, কলকাতা উচ্চ মাদরাসা এবং তার পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পড়েন। এমএ শেষ করার আগেই তিনি শিক্ষা বিভাগে চাকুরি নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন।
কাজী ইমদাদুল হক ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছাত্র জীবন থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৯০০ সালে ছাত্র জীবনে তার ছোট কবিতার পুস্তিকা ‘আঁখিজল’ প্রকাশিত হয়। ৯টি কবিতার সমস্টি ‘আঁখিজল’। কবিতা গুলিতে জীবনবোধ ও প্রকৃতি প্রেম একটি সহজ রূপ লাভ করেছে। ১৯০৩ সালে তিনি কলকাতা মাদরাসায় অস্থায়ী শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। সে বছর ২৬ ফেব্র“য়ারি ‘লতিকা’ নামে তার দ্বিতীয় কবিতার পাণ্ডলিপি প্রস্তুত করেন। তাতে ৫টি গীতি-কবিতা ও ৫টি সনেট অন্তভূক্ত হয়। কিন্তু ‘লতিকা’ পুস্তাকারে প্রকাশিত হয়নি। পরবর্তীতে পাণ্ডলিপির অন্তর্গত ৩টি কবিতা ও ২টি সনেট মাসিক ‘নবনূর’ এ প্রকাশিত হয়। ১৯০৩ সালের এপ্রিল মাসে ‘নবনূর’ প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম বৈশাখ সংখ্যাতে ইমদাদুল হক লেখেন “হিন্দু নারীর মুসলমান ঘৃণা”, জ্যোষ্ঠ সংখ্যায় লেখেন “আমাদের শিক্ষা” এবং “শিবাজী” বা “সাজাদী রোশিনারা”। ১৯০৩ সাল বাংলা ১৩১০ বঙ্গাব্দের বৈশাখের ‘ভারতী’ তে তার “হিন্দু-মুসলমান ও বঙ্গ-সাহিত্য” প্রকাশিত হয়। এ সকল রচনায় তিনি যে পাণ্ডিত্য ও বিদগ্ধচিত্ততার পরিচয় দেন, তা সমভাবে তৎকালীন হিন্দু-মুসলিম বিশিষ্ট জনের ব্যাপক প্রশংসিত হয়।
ইমদাদুল হক প্রথম জীবনে কবি-প্রতিষ্ঠাই কামনা করেছিলেন। কিস্তু সমাজ-চেতনা ও ইতিহাসচর্চা ক্রমে তাকে কাব্য-কল্পনা থেকে বাস্তব জীবনের নানা সমস্যার দিকে অধিকতার আকর্ষন করতে থাকে। কাব্যচর্চা অব্যাহত রাখলে তিনি একজন খ্যাতিমান কবি হতে পারতেন। ‘তরুওলতা’ কবিতাটি তার কবিত্ব শক্তির এক চমৎকার নিদর্শন। তার ‘ধুলাখেলা’, মায়া-বালিকা প্রভৃতি কবিতাতেও রবীন্দ্রনাথের “ছবি ও গান”, বিশেষতঃ ‘মানসী’ কাব্যের প্রভাবে অতঃপ্রবাহী। তার সনেটে রবীন্দ্রনাথের ‘কড়িও কোমল’ কাব্যের সনেট গুলির ছায়াপাত বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় না হলেও ভাবের ঐক্য আনন্দময়। তিনি তার সনেটে ৩ প্রকার অন্তমিল ব্যবহার করেছেন। তার কবির পতি; সনেটটি ১৯০০ সালের ফেব্র“য়ারিতে প্রচারক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কায়কোবাদ, মোজাম্মেল হক, সৈয়দ এমদাদ আলী, শেখ ফজলল করিম প্রমুখ সনেট প্রণয়নে অগ্রসর হন তার অনেক পরে। সুতরাং বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচনার গৌরব মুসলমানদের মধ্যে ইমদাদুল হকেরই প্রাপ্য।
কাজী ইমদাদুল হক ছিলেন একজন শক্তিশালী গদ্য লেখক। সাহিত্য জীবনের শুরু থেকেই তিনি পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখেছেন। ১৯১১ সালে ‘মোসলেম জগতে বিজ্ঞানচর্চা’ শীর্ষক প্রবন্ধ বইটি প্রকাশিত হয়। ১৯১৮ সালে তার সবচেয়ে মননশীল প্রবন্ধ-সংগ্রহ ‘প্রবন্ধমালা’ প্রকাশিত হয়। তার প্রবন্ধিক গদ্য স্বচ্ছ ও সাবলীল। এ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোর বিষয়বন্তু প্রাচীন মুসলিম ইতিহাস। তবে লিখেছেন সংস্কার মুক্ত মন নিয়ে- অন্ধ মুসলমানের মতো নয়।
ইমদাদুল হক স্কুল পাঠ্যবই রচনায় দক্ষ ছিলেন। তার ‘ভূগোল শিক্ষা প্রনালী দুই ভাগ ১৯১৩ ও ১৯১৬ সাল, সরল সাহিত্য ১৯১৮ সাল, প্রাথমিক জ্যামিতি ১৯১৮ সাল, ঐতিহাসিক পাঠ ১ম ও ২য় ভাগ ১৯১৮ সাল, প্রভৃতি বহুবছর পূর্ব বাংলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল। তার স্কুল পাঠ্য বই যথেষ্ঠ উঁচু মানের।
শিশু-কিশোর রচনায় ইমদাদুল হকের দক্ষতা অসামান্য। তার ‘নবিকাহিনী’ কিশোর পাঠ্য জীবনী ১৯১৭ সালে প্রকাশিত হয়। এতে তিনি হযরত মোহম্মদ (সাঃ) থেকে কোরআন শরীফে যে সকল নবি-পয়গম্বরের কথা আছে যেমন- হযরত আদম, হযরত নূহ, হযরত ইব্রাহিম, হযরত ইউসুফ, হযরত মুসা, হযরত আয়ুব, হযরত দাউদ, বিবি রহিমা, হযরত সোলেমান, হযরত ঈসা সম্মন্ধে প্রজ্ঞল ভাষায় তাদের নীতি-শিক্ষার কথা বর্ণনা করেছেন। বাংলা ভাষায় এটি একটি অসামান্য বই।
‘বোগদাদী গল্পঃ কামারের কান্ড’ একটি আরব্যরজনীর কাহিনী ভিত্তিক গল্পের বই। শিশুদের জন্য লেখা কাহিনীটি পুরনো উপকথা বটে, কিন্তু বলার ভঙ্গিটি নতুন ও সুন্দর। তার ভাষা ঝর ঝরে।
ইমদাদুল হকের স্মরণীয় সাহিত্য কর্ম তার একমাত্র উপন্যাস ‘আব্দুল্লাহ’। বহুদিন শয্যাশায়ী থাকার কারণে ‘আব্দুল্লাহ’ তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিশালী ঔপন্যাসিক হওয়ার সম্ভাবনা তাঁর অকালমৃত্যু নস্যাৎ করে দেয়। ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখে মোসলেম ভারত আত্মপ্রকাশ করে। তার প্রথম সংখ্যা থেকেই ইমদাদুল হকের ‘আব্দুল্লাহ’ উপন্যাস ধারাবাহিকরূপে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির ৩০ পরিচ্ছেদ পর্যন্ত বের হয়েছিল। পরবর্তী ২টি পরিচ্ছেদের পাণ্ডলিপি তিনি প্রস্তুত করেছিলেন; কিন্তু মোসলেম ভারত ১৩১৮ বঙ্গাব্দের পৌষের ২য় বর্ষ ৫ম সংখ্যার পর অকালে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে অংশটুকু প্রকাশিত হয়নি। তার মৃত্যুরপর ‘আব্দুল্লাহ’ উপন্যাসের যে ৩০ পরিচ্ছেদ মোসলেম ভারতে প্রকাশিত হয়েছিল, তার পরের ১১ পরিচ্ছেদ রচনা করেন অধ্যাপক কাজী আনোয়ারুল কাদীর। এই অংশটুকুর খসড়া ইমদাদুল হক রেখে গিয়েছিলেন। তারই উপরে ভিত্তি করে আনোয়ারুল কাদির উপন্যাসখানি সম্পূর্ণ করেন।
১৯১৯ সালে ইমদাদুল হক শিক্ষা বিভাগের কাজে গভীর দায়িত্ববোধ, অসামান্য দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তির স্বীকৃতি স্বরূপ ‘খান সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯২১ সালের মে মাসে ঢাকা বোর্ড অব ইন্টারমিডেট ও সেকেন্ডারী এ্যাডুকেশন স্থাপিত হলে তিনি তার প্রথম সেক্রেটারী নিযুক্ত হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। এই বোর্ডকে সুশৃংখলভাবে গড়ে তুলবার জন্য তাকে এত গুরুতর পরিশ্রম করতে হয় যে, তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। ১৯২৬ সালে তিনি ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হন। কিন্তু আনন্দের রেশ কাঁটতে না কাঁটতেই তার মূত্রাশয়ের পীড়া পুনর্বার দেখা দেয়। তিনি হেকিমী মতে চিকিৎসার্থ দিল্লী যাত্রা করেন; কিন্তু পথে কলকাতায় অবস্থানকালে ১৯২৬ সালের ২০ মার্চ রাতে চুয়াল্লিশ বছরেরও কম বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন।
লেখক ঃ সাংবাদিক