শিরোনাম:
পাইকগাছা, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩১

SW News24
বুধবার ● ২৮ আগস্ট ২০১৯
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্য ও জন্মাষ্টমী
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্য ও জন্মাষ্টমী
১১৪৫ বার পঠিত
বুধবার ● ২৮ আগস্ট ২০১৯
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্য ও জন্মাষ্টমী

---

প্রকাশ ঘোষ বিধান

 

    জন্মাষ্টমী হিন্দু ধর্মাবালম্বীদের অন্যতম প্রাচীন ধর্মীয় উৎসব। এটি বিষ্ণু অবতার কৃষ্ণের জন্মদিন হিসাবে পালিত হয়। এর অপর নাম কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী, অষ্টমীরোহিনী, শ্রীকৃষ্ণজয়ন্তী ইত্যাদি। হিন্দু পঞ্জিকা মতে, সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিনী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয় তখন জন্মাষ্টমী পালিত হয়। উৎসবটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রতি বছর মধ্য থেকে মধ্য সেপ্টেম্বরের মধ্যে যে কোন সময় পড়ে। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন দেবকী ও বসুদেব এর সন্তান এবং হিন্দু ধর্মাবালম্বীরা তার জন্মদিন জন্মাষ্টমী হিসাবে পালন করে।

পুরানো পুঁথির বর্ণনা এবং জ্যোতিষশন্ত্রের গণনা অনুসারে খ্রীষ্টপূর্ব ৩১০১ সালে শ্রীকৃষ্ণ জন্ম গ্রহণ করেন। কৃষ্ণ দেবকী এবং বসুদেবের অষ্টম সন্তান ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সময় চারিদিকে অরাজকতা, নিপীড়ন, অত্যাচার চরম পর্যায়ে ছিল। সেই মানুষের স্বাধীনতার বলে কিছু ছিল না। সর্বত্র ছিল অশুভ শক্তির বিস্তার।

ঐশ্বর্য অর্থ- সর্ববশীকারিতা, যে শক্তিতে কেবল ঈশ্বরের ভাব প্রকাশিত হয়। যে শক্তি সকলকে বশীভূত করতে পারে তারই নাম ঐশ্বর্য। শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ, জিনি শাশ্বতকাল ধরে সম্পূর্ণ ভাবে সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী। শ্রীকৃষ্ণই পূর্ণ ঐশ্বর্য সম্পন্ন, পরম পুরুষ, পরমেশ্বর ভগবান। পূর্ণমাত্রায় ঐশ্বর্যসমূহের অধিকারী হওয়ার শ্রীকৃষ্ণ পরম আকর্ষক, তিনি সর্বাকর্ষক পরম পুরুষ। সে জন্য তার নাম কৃষ্ণ, যিনি সকলকে আকর্ষক পূর্বক আনন্দ প্রদান করেন।

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্ম দিনকে জন্মাষ্টমী বলা হয়। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকষ্ণের ৫২৪৫মত জন্মাষ্টমী। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ১২৫ বছর প্রকট লীলাবিলীস করেন। ১২৫ বছর ধরাধামে অবস্থান করে গোলকে গমন করেন। মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে ইহধান ত্যাগ করে অন্তধান করেন। সেই দিনে কলি প্রবেশ করেছে। খ্রীষ্টপূর্ব ৩১০১ এ কলি যুগের আরাম্ভ। ২০২১ সালে কলির বয়স ৫১২০ বছর। শ্রীকৃষ্ণের অন্তধানের দিনই কলির আবির্ভাব। তাহলে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ৫১২২ +১২৫= ৫২৪৭ বছর পূর্বে হয়েছিল অর্থাৎ ২০২১  সালে মাঘিপূর্ণিমা থেকে ৫২৪৭  বছর পূর্বে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল।

দ্বাপর যুগের শেষের দিকে কোন এক ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষীয় অষ্টমী তিথিতে মথুরা দেশের রাজা কংসের কারাগারে ভগবানের অবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্ম এবং ভগবানের মায়ার প্রভাবে কারাগারের বাহিরে আসা। জন্মাষ্টমী তিথি, শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি। কৃষ্ণ শব্দের সংস্কৃত অর্থ হলো কালো। কৃষ্ণের প্রচালিত মূর্তিগুলো সাধারণত বংশীবাদক এক বালক বেশে আমাদের দৃষ্টনন্দিত হয়। কৃষ্ণের জন্ম মথুরায় তবে বেড়ে উঠেন গকুলে মাতা যশোদা ও পিতা নন্দের কাছে। শ্রীকৃষ্ণের মোট ১০৮টি নাম রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের নাম দিয়ে যে নৃত্য রয়েছে তার নাম রাসলীলা। মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের পরাস্ত করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে কথা বলেছিলেন, সেই কৃষ্ণের বাণী শ্রীমদ্ভাগবত গীতা নামে পরিচিত। জন্মাষ্টমী উৎসব বিষ্ণুভক্ত বৈষ্ণদের এক বড় আর প্রিয় আদরের উৎসব।

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, পৃথিবী থেকে দুরাচারী দুষ্টদের দমন আর স্বজনদের রক্ষার জন্যই স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুর পূর্ণাবতার স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন।

ধর্মগ্রন্থ গীতায় বলেছেন……..

“যদা যদাহি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানমধর্ম্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।৭”

অর্থঃ- (৭) হে ভারত ! যখনই যখনই ধর্ম্মের গ্লানি এবং অধর্ম্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি সেই সেই সময়ে নিজেকে সৃষ্টি করি (দেহ ধারণপূর্ব্বক অবতীর্ণ হই)।

“পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চদুস্কৃতাম্।

ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।৮”

অর্থঃ- (৮) সাধুগণের পরিত্রাণ, দুষ্টদিগের বিনাশ এবং ধর্ম্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।

তখন দ্বাপর যুগ। অসুর রাজারা ছিলো খুবই অত্যাচারী। তখন উগ্রসেন নামে মথুরার এক রাজা ছিলো। রাজা ছিলো প্রচন্ড রকমের ধার্মিক। কিন্তু রাজা ধার্মিক থাকলে কি হবে, তার ছেলে কংস ছিল খুবই অত্যাচারী। কংসের অত্যাচারের মাত্রা এতটাই বেশী ছিল যে নিজের পিতা উগ্রসেনকেও সিংহাসনচ্যুত করে কারাবন্ধী করে নিজেই মথুরায় রাজত্ব করতো। কংসের বোন দেবকীর বিবাহ হয় বসুদেবের সঙ্গে। বর কণেকে রথের উপর বসানো হয়েছে এবং রথের সারথী হচ্ছে কংস। রথ চলছে এমন সময় হঠাৎ করে সেই দৈববাণীটি কংসের কানে বেজে উঠলো, “ওরে নির্বোধ যাকে তুমি রথে করে নিয়ে যাচ্ছো তার গর্ভের অষ্টম সন্তান তোমার প্রাণ হরণ করবে।” দৈববাণী শুনে কংস সঙ্গে সঙ্গে খড়গ হাতে দেবকীকে হত্যা করার জন্য উদ্যোত হলো। এ দেখে বসুদেব কংসকে অনেক সবিনয় অনুরোধ করে রাজী করালো এই বলে যে, তাদের সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পরই কংসের হাতে তুলে দেওয়া হবে। একথা শুনে কংস শান্ত হলো ঠিকই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেবকী ও বসুদেবকে কারাগারে বন্ধি করলো।

একে একে জন্ম নিলো ছয়টি সন্তান। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর পরই কংস আসে এবং বসুদেব পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো নিজেদের সন্তানকে কংসের হাতে তুলে দেয়। আর কংস সঙ্গে সঙ্গে পাথরের সাথে আছাড় দিয়ে সন্তানটিকে মেরে ফেলে। সপ্তম গর্ভের সন্তান যখন বলদেব অধিষ্ঠিত হয়েছিলো তখণ ভগবানের নির্দেশে যোগমায়াবলে দেবকীর গর্ভ হতে তাকে স্থানান্তরিত করে নন্দালয়ে রোহিনীর গর্ভে স্থাপন করে এবং প্রচার করা হয় দেবকীর গর্ভপাত হয়েছে।

এবার অষ্টম গর্ভের সন্তান অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মগ্রহণ করার পালা। কারাগারের বাইরে পূর্বের চেয়ে কংস এবারও আরও বেশী পাহারার ব্যবস্থা করলো। মাস ছিলো ভাদ্র, তিথি ছিলো অষ্টমী এবং রজনী ছিলো ভীষণ দুর্যোগময়। প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে প্রকৃতি ধারণ করে এক অন্যরকম মূর্তি, বিদ্যুৎ উচ্ছ্বলিত ঠিক এমন সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবকীর গর্ভে আবির্ভূত হন এবং দৈববানী শোনা যায় “বসুদেব, তুমি এখনই গোকুলে যেয়ে নন্দের স্ত্রী যশোদার পাশে তোমার ছেলেটিকে রেখে এসো এবং এই মুহূর্তে তার যে কন্যা শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছে তাকে এনে দেবকীর কোলে শুয়ে দাও। আমার মায়ায় পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এখন গভীর ঘুমে অচেতন, যার ফলে কেউ কিছুই জানতে পাবে না।” সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে নিয়ে বসুদেব ছুটতে লাগলো নন্দের বাড়ীর দিকে। পথে যমুনা নদী। বর্ষাকাল তাই যমুনা কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিলো। তখন বসুদেবের নিরুপায় মনে হলো। হঠাৎ করে বসুদেব দেখলো যমুনার জল শুকিয়ে গিয়েছে এবং একটা শৃগাল যমুনা নদী পার হয়ে যাচ্ছে। বসুদেব তখন ঐ রূপধারী শৃগালকে পথ প্রদর্শক মনে করে তার পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগলো। এমন সময় প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। বসুদেব ও শ্রীকৃষ্ণকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য নাগরাজ তার বিশাল ফণা বিস্তার করলো তাদের মাথার উপরে। কিছু সময়ের মধ্যে বসুদেব তার ছেলেকে যশোদার কোলে রেখে যশোদার কন্যা যোগমায়াকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে এল। ভগবত পুরান অনুযায়ী কোন প্রকার যৌন সংগম ছাড়াই কেবল মাত্র মানুসিক যোগের ফলে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন সে যুগে এ ধরনের যোগ সম্ভব ছিল।

সকাল বেলা কংস খবর পেল দেবকীর অষ্টম সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কারাগারে চলে এসে দেবকীর কোল থেকে মেয়েটিকে ছিনিয়ে নিয়ে একই ভাবে পাথরের উপরে আঁছাড় মারতেই মেয়েটি শূন্যে উঠে যেয়েই যোগমায়া মূর্তি ধারণ করে। মহাশূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার পূর্বে কংসকে বলে গেলো, “তোমাকে বধিবে যে গোকূলে বেড়েছে সে”। এই কথা শুনে কংস মথুরার সকল শিশুকে মারার পরিকল্পনা করে। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি।

নন্দ ছিলেন বৃন্দাবনের গোপালক সম্প্রদায়ের প্রধান। শৈশাবে কৃষ্ণ রাখাল বালক হয়ে বেড়ে ওঠেন। শৈশবেই কৃষ্ণ এতটায় অপ্রতিরোধ্য ছিলেন যে, তার প্রাণনাশের চেষ্টা গুলি চমক প্রদভাবে প্রতিরোধ করতেন এবং বৃন্দাবনবাসীর জীবন রক্ষা করতেন। কৃষ্ণের প্রাণনাশের জন্য কংসের প্রেরিত পুতনাসহ অন্যান্য রাক্ষসদের তিনি হত্যা করেন। অবশেষে কংস কৃষ্ণ বধের জন্য মথুরায় মল্লক্রীড়ার আয়োজন করে। আমন্ত্রন জানানো হয় কৃষ্ণ ও বলরাম কে। মল্লক্রীড়ায় উপস্থিত হন চারপাশের রাজন্যবর্গ। কৃষ্ণ বধের অলিক আশায় কংস তখন আত্মহারা। ক্রীড়া প্রাঙ্গনের সামনে পাগলা হাতী রাখা হয় কৃষ্ণকে পিষে মারা জন্য। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে কংস চানুর ও মুষ্টিক নামে দুই খ্যাতিমান অত্যন্ত বলবান মল্লবীরকে কৃষ্ণ হত্যার জন্য উপস্থিত রাখেন। কিন্তু অন্তযামী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসের সব চক্রান্ত ব্যার্থ করে দেন। তার মুষ্টির আঘাতে মারা যায় হাতী, চানুর ও মুষ্টিক। হতভম্ভ কংস রাজেন্যবর্গ, সেনাদল, সহচর সবাইকে তার পক্ষে অস্ত্র ধারন করতে বলেন। কিন্তু কেহ সাড়া দেয়নি। তখন নিরুপায় কংস যুদ্ধনীতি লঙ্ঘন করে অস্ত্র ধারন করা মাত্র কৃষ্ণ সিংহের মত প্রবল বিক্রমে কংসের উপর ঝাপিয়ে পড়েন। অবশেষে কৃষ্ণের লোহ মুষ্টির আঘাতে কংসের মৃত্যু হয়।

প্রতি বছর শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন তথা জন্মাষ্টমি মানব সমাজকে শিক্ষা দেয় সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির বন্ধনে বিশ্ব সমাজকে আবদ্ধ করতে। শ্রীকৃষ্ণের জীনব দর্শন এক শান্তিময় বিশ্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জন্মাষ্টমি আমাদের মাঝে নিয়ে আসে এক শুভ বার্তা।

 

লেখকঃ সাংবাদিক

 





আর্কাইভ