মঙ্গলবার ● ২৮ জানুয়ারী ২০২০
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী সরস্বতী
জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী সরস্বতী
প্রকাশ ঘোষ বিধান ।
বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী। সনাতন ধর্মাবম্বীদের মতে দেবী সরস্বতী সত্য, ন্যায় ও জ্ঞানালোকের প্রতিক। বিদ্যা, বানী ও সুরের অধিষ্ঠাত্রী। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মাঘ মাসে পঞ্চম তিথিতে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীপঞ্চমী বা বসন্তী পঞ্চমী নামে তিথিটি পরিচিত। এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি আনন্দঘন দিন হচ্ছে সরস্বতী পূজা।
হিন্দু ধর্মানুসারীদের বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি আনন্দঘন দিন হচ্ছে সরস্বতী পূজা। প্রতি বছর মাঘ মাসের শুল্ক পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সনাতন ধর্ম মতে ঈশ্বরের বিদ্যা, সঙ্গীত, শিল্পকলা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী প্রজ্ঞাশক্তিরূপ দেবী মাতা সরস্বতী। ঈশ্বর সকল ধরনের শক্তির উৎস। হিন্দু দর্শনমতে তিনি যখন জ্ঞানদাতা হিসেবে কাজ করেন তখন তাকে মাতৃরূপে পূজা করা হয়। মা যেমন স্নেহবাৎসল্যে, সোহাগে শিশুকে জন্মের পর থেকে আধোআধো বুলির মাধ্যমে পৃথিবীর জ্ঞান প্রথম তার শিশুকে প্রদান করেন তেমনি ঈশ্বর মাতৃরূপেই আমাদের জ্ঞান দান করেন। যিঁনি মানুষের অন্তরে মহান জ্ঞানসমুদ্রকে প্রকাশ করেন এবং মেধা ও মননকে দীপ্তি দান করেন। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায় অধ্যয়নরত বিদ্যার্থীরা এই পূজা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করে থাকেন। মাতা সরস্বতী জ্ঞানদায়িনী অর্থাৎ কল্যাণ ও শান্তি বিধায়িনী, তিনি বরদা এবং জাগতিক মোহ ধ্বংসকারী। ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু তিনি বহুরূপে বিরাজমান। ব্রহ্মের লক্ষণ দু’টি- স্বরূপলক্ষণ ও তটস্থলক্ষণ। স্বরূপলক্ষণে তিনি স্বগুণ, সাকার, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কার্যের অধিকর্তা, তিনি এই নিখিল বিশ্বের প্রভু, তিনিই ঈশ্বর, তিনিই জ্ঞানময়।
সরস্বতী সর্বশুক্লা, তাঁর শ্রীহস্তে বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্তাদি, তিনি বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, তিনি সকল তমঃ নাশ করেন, তিনি বাগ্দেবতা, তাঁর নয়ন বিশাল ও পদ্মের ন্যায়, তিনি সকল ঐশ্বর্যের সিদ্ধিদায়িনী। বেদে সরস্বতী সম্পর্কে স্পষ্ট করেই উল্লেখ করা হয়েছে। বেদোক্ত সরস্বতীর তিন রূপ- ভূঃ বা ভূলোকে ইলা, ভুর্বঃ বা অন্তরীক্ষলোকে সরস্বতী এবং স্বও বা স্বর্গলোকে ভারতী। ভূঃ র্ভুবঃ স্বঃ- এই তিন মিলেই সামগ্রিক জগত। ভূলোকে অগ্নি, অন্তরীক্ষ লোকে ইন্দ্র এবং স্বর্লোকে সূর্য-এ তিনের যে জ্যোতিরাশি তা সরতীরই জ্যোতি। জ্ঞানময়ী বা চিন্ময়ীরূপে তিনি সর্বত্র, সর্বব্যাপিনী। তাঁর অমিয়ধারা বিশ্বে বিশ্বে পরিব্যাপ্ত। সে প্রভাময় আলোক জগতের জমাটবাঁধা তমোরাশি অপনীত করে। তার জ্যোতির জ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান, এই জ্যোতিঃই প্রণব, এই জ্যোতিইঃ সরস্বতী, তিনিই ঈশ্বর। পরমেশ্বর যখন জ্ঞানময় তখন তিনি সরস্বতী। মাতৃশক্তিরূপে তিনি কখনো মহালক্ষ্মী, কখনো মহাকালী, কখানো মহাসরস্বতী। মা সন্তানের ত্রাতা তাই মা সন্তানের বিপদে নিজেই যুদ্ধে নেমে পড়েন, মা মনে করেন তার সন্তান সর্বদাই ছোট্ট ও আদরের। বিপদে তিনি স্থির থাকতে পারেন না আর পিতা চান সন্তানের স্বাবলম্বন তিনি সন্তানকে সামনে এগিয়ে যেত বলেন কিন্তু স্বয়ং সাহায্য না করে সন্তানকে দিয়ে কর্তব্যকর্ম করিয়ে নেন। আর যে কারণে ঈশ্বরের দুটি রূপ মাতৃশক্তি আর পিতৃশক্তি আর এভাবে জ্ঞানময়ী, বিদ্যাদাত্রী মা সরস্বতীর প্রকাশ। সরস্বতী শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ ‘সরস+বতু’ স্ত্রী লিঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যায় যুক্ত সরস্বতী। ‘সরস’ শব্দের অর্থ জ্যোতি ও জল আর আলোকময়ী বলেই তিনি সর্বশুক্লা। বেদে কখানো তাকে নদীরূপে কখনো দেবীরূপ আবাহন করা হয়েছে। নদী কেবল জলের আধার নয়, নাদ তথা শব্দেরও আদি উৎস। বাকদেবীরূপে সরস্বতী তাই নাদময়ী।
বৈদিক যুগে পূণ্যভূমি ভারতবর্ষে সরস্বতী নামে নদীর অস্তিত্বের কথা উল্লেখ রয়েছে। এখানেই ঋষিরা ধ্যানস্ত সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন। এখানেই ফুটেছিল পৃথিবীর প্রথম বিদ্যালোক। সরস্বতীদেবী এবং উচ্ছ্বাসময়ী নদী সরস্বতী উভয়েই অভিন্নতা। পুরাকালে সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞ সম্পাদন হত এবং ক্রমে সে সরস্বতী নদী পবিত্র মন্ত্রের দেবী ও বাগদেবী বলে পরিণত হলেন। বেদে সরস্বতী শুধু বিদ্যাদায়িনী বা জ্ঞানদায়িনী নন, তিনি অশুভ শক্তি ধ্বংসকারীও বটে। দেবী সরস্বতী শুচি শুভ্র, শ্বেত অঙ্গকান্তি, শ্বেতপদ্মাসীনা এবং শ্বেত হংসবাহনা। তাঁর কৃপায় মানুষের জাগতিক এবং পারমার্থিক জ্ঞান লাভ হয়। তিনি সঙ্গীতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সঙ্গীত ও রাগের সমন্বয়ে ‘ওঁ’ কার ও গায়ত্রী মন্ত্র শুদ্ধাচারে উচ্চারণে জীবাত্মা পরমাত্মায় লয় হয়।
সরস্বতী পূজার দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পারিবারিক মন্ডপে খুব সকালে শুরু হয় পূজার আয়োজন। মন্দিরে প্রতীমার সামনে বই-খাতা ও শিক্ষাসামগ্রী রেখে বিদ্যার্থীগণ তাদের সামনের দিনের বিদ্যা অর্জনের সাফল্যময় পথ প্রার্থনা করেন দেবীর নিকট। হিন্দুশাস্ত্র মতে বিদ্যা দুই প্রকার- পরাবিদ্যা আর অপরা বিদ্যা অর্থাৎ আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও পার্থিব জ্ঞান এই উভয় জ্ঞানই মানুষকে তার জীবদ্দশায় অর্জন করতে হয়। জ্ঞানসাধনার সাথে আত্মিক ক্রমবিকাশের সম্পর্ক নিবিড়। সরস্বতী পূজার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের ক্ষুদ্র গন্ডী অতিক্রম করে বৃহৎ জ্ঞানসমুদ্রে বিচরণ। সরস্বতীর শ্বেতশুভ্র ভূষণের ন্যায় নিজের সকল কালিমা স্বচ্ছ আলোয় ধূয়ে, মনের মলিনতাকে পরিহার করে ব্যবহারিক জীবন ও পারলৌকিক জীবনের পরিপূর্ণতাই সরস্বতী পূজার মহান আদর্শ। পদ্মে আসীনা মাতা সরস্বতী কেননা মানুষ জ্ঞানরূপ চক্ষু দ্বারা নিজের জগতে শতদলের মতো প্রস্ফুটিত করবে, সকল অশুভকে পরিহার করে শতদলের ন্যায় আলোয় উদ্ভাসিত হবে। হিন্দুধর্মের পূজাপার্বণ অনেকাংশে ঋতুভিত্তিক। সরস্বতী পূজা শীত ঋতুভিত্তিক- যখন চারিদিকে জাড্য, আলস্য, দিনের থেকে রাত্রি দীর্ঘ তখনই সকল কালিমা, অলসতা ও ভীরুতা দূর করতে আগমনী ধ্বনি বেজে ওঠে আকাশে বাতাসে। সম্মুখে বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে দেবী আমাদের এই কথা শুনিয়ে যান জ্ঞানরূপ তরী আমাদের সামনে সকল আধার, অসঙ্কোচ ও অন্ধকার দূর হয়ে যাচ্ছে। হিন্দুদর্শন জ্ঞান ও শিক্ষাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে। সরস্বতীর যথার্থ তাৎপর্য হৃদয় ধারণ করে মা’কে পূজা আর্চনা করা উচিৎ, নয়তো পূজার আড়ম্বরতা যতই হোক না কেন তা অর্থহীন।
জ্ঞানদায়িনী বিদ্যার দেবী সরস্বতী। তিনি বিদ্যা দান করেন, ‘শ্রদ্ধাবান লভেতে জানং তৎপরঃ সাংযতেন্দ্রিয়” অর্থাৎ শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি জ্ঞান লাভ করে থাকেন। উপনিষদের সেই বাণী আমাদের সকলের অন্তরের জ্ঞানের সুপ্ত আলোকে বিকশিত করুক- অসতো মা সদ্গময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়। মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়। আবিরাবীর্ম এধি। অর্থাৎ হে ঈশ্বর আমাকে অসৎ থেকে সৎ লোকে, অন্ধকার থেকে আলোতে এবং মৃত্যু থেকে অমৃতে নিয়ে যাও।
লেখক ঃ সাংবাদিক