শিরোনাম:
পাইকগাছা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩১

SW News24
শনিবার ● ২০ জুন ২০২০
প্রথম পাতা » ইতিহাস ও ঐতিহ্য » বর্ণাঢ্য এক জীবন রেখে গেলেন কামাল লোহানী
প্রথম পাতা » ইতিহাস ও ঐতিহ্য » বর্ণাঢ্য এক জীবন রেখে গেলেন কামাল লোহানী
৪৮৮ বার পঠিত
শনিবার ● ২০ জুন ২০২০
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

বর্ণাঢ্য এক জীবন রেখে গেলেন কামাল লোহানী

---এস ডব্লিউ নিউজ: করোনা ভাইরাস একে একে কেড়ে নিচ্ছে আমাদের প্রিয় মুখ, প্রিয় মানুষগুলোকে। আমরা হারাচ্ছি জাতির সূর্য সন্তানদের। শনিবার সকালে এই তালিকায় যুক্ত হলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। করোনায় আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি। রেখে গেলেন বর্ণাঢ্য একজীবনের স্মৃতিগাঁথা।

জন্ম:

কামাল লোহানী নামে তার পরিচিতি থাকলেও পারিবারিক নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। কামাল লোহানীর পরিবারের বসতি ছিল যমুনা পাড়ে। খাস কাউলিয়ায়। আগ্রাসী যমুনা-গর্ভে তাদের বাড়িঘর জমি-জিরেত চলে যাওয়ার পর তারা সিরাজগঞ্জেরই উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। আর এই সনতলা গ্রামেই ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন কামাল লোহানী জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী।

শিক্ষাজীবন:

মাত্র ৬-৭ বছর বয়সে কামাল লোহানীর মা মৃত্যুবরণ করেন। একান্নবর্তী পরিবারে বাস হওয়ায় বাবা তাকে গ্রামে না রেখে পাঠিয়ে দিলেন নিঃসন্তান ফুফুর কাছে কলকাতায়। সেখানে শিশু বিদ্যাপীঠে পড়াশুনা শুরু করেন তিনি। এখানে এসে তিনি বেড়ে উঠতে লাগলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এক বিভীষিকাময় দুর্যোগের মধ্যে। জাপানী বোমার শব্দের ভয়ে কিশোর কামাল লোহানী শিশু বিদ্যাপীঠে গেছেন কানে তুলো দিয়ে।

দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে তিনি পাবনা চলে যান। ভর্তি হন পাবনা জিলা স্কুলে। ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। এরপর ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। থাকেন ছোট কাকা শিক্ষাবিদ ও লেখক তাসাদ্দুক হোসেন খান লোহানীর কাছে। এই কলেজ থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন তিনি। আর উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন কামাল লোহানী।

কারাজীবন:

কামাল লোহানীর ছিল বর্ণাঢ্য জীবন। এ জীবনে তিনি কয়েকবার কারাবরণও করেছেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হওয়ার পর যখন কলেজ নির্বাচন এগিয়ে এলো তখন কামাল লোহানীসহ আরো ক’জন সমমনা একজোট হয়ে জোট বাঁধলেন, নাম দিলেন ‘পাইওনিয়ার্স ফ্রন্ট’। লড়লেন নির্বাচনে এবং নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেন। এই ফ্রন্টের সদস্যরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর গড়ে ওঠা প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। এছাড়া তারা রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়াও সেইসময় সাংস্কৃতিক কাজে বেশ সক্রিয় ছিলেন। সুতরাং কামাল লোহানীও এ থেকে বাইরে রইলেন না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে সক্রিয় ভূমিকা নিতে থাকলেন। উপস্থাপনা, গ্রন্থনা এবং আবৃত্তিতে পাঠ নিলেন তিনি।

১৯৫৩ সালে পাবনার তৎকালীন জিন্নাহ্ পার্কে (বর্তমান স্টেডিয়াম) মুসলিম লীগ কাউন্সিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এইখানে যোগদানের জন্য আসেন তৎকালীন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সর্দার আব্দুর রব নিশতার, কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতা খান আব্দুল কাউয়ুম খান, প্রাদেশিক লীগ নেতা মোহাম্মদ আফজাল প্রমুখ। ছাত্র হত্যাকারী নূরুল আমিনের পাবনা আগমন ও মুসলিম লীগ সম্মেলনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করায় কামাল লোহানী পাবনার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের সাথে প্রথম গ্রেফতার হন।

১৯৫৪ সালের মার্চে পূর্ববাংলায় অনুষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক নির্বাচন। কামাল লোহানী তথা সকল প্রগতিশীল ছাত্ররাই যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাবনা টাউন হলে মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে গণজমায়েত এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

বিপুল জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে তৎকালীন সরকার তটস্থ হয়ে পরদিন গ্রেফতার শুরু করে। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে কামাল লোহানী গ্রেপ্তার হন। এবং যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ে নির্বাচনের পর মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু মার্কিনী মদদপুষ্ট পাকিস্তান সরকার এই বিজয়কে গ্রহণ করেনি। এবং শঙ্কিত হয়ে ১৯৫৪ সালের ২৯ মে ৯২-(ক) ধারার মাধ্যমে পূর্ববাংলায় ‘গভর্নরী শাসন’ চালু করে। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ববাংলায় গভর্নর হয়ে আসে এবং ব্যাপক ধরপাকড়ের নির্দেশ দেন।

কলেজ ছুটি থাকায় কামাল লোহানী গ্রামের বাড়ি চলে যান। এসময় খান সনতলা গ্রাম থেকে ১লা জুন পুনরায় গ্রেফতার হন তিনি এবং উল্লাপাড়া থানা হাজতে দিনভর থাকার পর রাতে তাকে পুলিশ পাহারায় পাবনা ডিসট্রিক্ট জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঈদের দিন পাবনা জেলে ‘রাজবন্দি’ হিসেবে কারাজীবন শুরু করেন কিন্তু কিছুদিন পর রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় এবং ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন তিনি।

১৯৬২ সালেও কামাল লোহানী কিছুদিনের জন্য কারাগারে বন্দী ছিলেন। ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গর্জে উঠলো। কামাল লোহানীর নামে জারি হল হুলিয়া। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি গ্রেফতার হলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পরিস্থিতি আরও সংকটাপন্ন হল। ১৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে গ্রেফতার হলেন তিনি। এই সময় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ২৬ নম্বর সেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, আবুল মনসুর আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো, অধ্যাপক রফিকুল ইসলামসহ অনেকেই একসাথে ছিলেন। সাড়ে তিন মাস পরে তিনি মুক্তি লাভ করেন।

রাজনীতি:

রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তির পর কামাল লোহানী ফিরে এলেন পাবনায়। কিন্তু অভিভাবকদের সাথে তার শুরু হলো রাজনীতি নিয়ে মতবিরোধ। অভিভাবকরা চাইছিলেন লেখাপড়া শেষে রাজনীতি করো, আপত্তি নেই। কিন্তু কামাল লোহানী তখন রীতিমত রাজনীতি প্রভাবিত এবং মার্কসবাদের অনুসারী। চোখে তার বিপ্লবের ঐশ্বর্য। আর তাই উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন কামাল লোহানী।

ছোট চাচা শিক্ষাবিদ তাসাদ্দুক লোহানীর কাছ থেকে মাত্র ১৫ টাকা চেয়ে নিয়ে অনিশ্চিতের পথে ঢাকা অভিমুখে পা বাড়ান কামাল লোহানী। জীবনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করলেন। আর সেই সঙ্গে শুরু হল তার নিজের পায়ে দাঁড়াবার সংগ্রাম।

১৯৫৫ সালে তিনি ন্যাপ-এ যোগ দেন এবং জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে দেশ বিপন্ন হলে, কামাল লোহানী আত্মগোপন করতে বাধ্য হন।

সংসার জীবন:

১৯৬০ সালে কামাল লোহানী বিয়ে করেছিলেন তারই চাচাতো বোন দীপ্তি লোহানীকে। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়নকালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং আন্দোলনের সাথী ছিল স্ত্রী দীপ্তি লোহানী।

কামাল লোহানী ও দীপ্তি লোহানী দম্পতির এক ছেলে ও দুই মেয়ে। তারা হলেন-সাগর লোহানী, বন্যা লোহানী, ঊর্মি লোহানী। প্রত্যেকেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট। পুত্র সাগর লোহানী পেশায় সাংবাদিকতা এবং চিত্র নির্মাণের সাথে যুক্ত। জ্যেষ্ঠ কন্যা বন্যা লোহানী চাকুরীর পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন। কনিষ্ঠ কন্যা ঊর্মি লোহানী অনলাইন আর্কাইভ গুণীজন ডট কম পরিচালনায় সম্পৃক্ত ।

কর্মজীবন:

১৯৫৫ সালে রাজশাহী কারাগার থেকে মুক্তির পর ঢাকায় এসে তিনি তার চাচাতো ভাই ফজলে লোহানীর সহযোগিতায় দৈনিক ‘মিল্লাত’ পত্রিকায় ৮০ টাকা বেতনে সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন। হাতেখড়ি হল সাংবাদিকতায়। একজন কলম সৈনিক হিসেবে শুরু হলো তার নতুন করে পথচলা।

১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দৈনিক ‘সংবাদ’-এ সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দিয়ে অল্প দিনেই শিফট-ইন-চার্জ পদে উন্নীত হন। এরপর তিনি ‘পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেট’-এ যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে সিন্ডিকেট প্রায় বন্ধের উপক্রম হলে কামাল লোহানী অবজারভার গ্রুপ অব পাবলিকেশন্সের দৈনিক ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকায় শিফট ইনচার্জ হিসেবে যোগ দেন। পরে চীফ সাব- এডিটর পদে উন্নীত হন। এই সময় তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দু’দফায় যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে তিনি পূর্বপাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ- এর পর যতদিন তিনি পূর্ববাংলায় ছিলেন, ততদিন সামরিক শাসকচক্রের নানা দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে তৎপর ছিলেন। এইসময়ে তিনি প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় কয়েকটি অগ্নিগর্ভ প্রতিবেদন রচনা করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি দায়িত্ব নিলেন ঢাকা বেতারের। দেশ স্বাধীন হলেও প্রশাসনে পরিবর্তন আসেনি বলে অনেকটা নীরব প্রতিবাদেই ট্রান্সক্রিপশন পরিচালক হিসেবে তিনি বেতার ত্যাগ করেন। ১৯৭৩ সালে ২০ জানুয়ারি পুনরায় সাংবাদিকতায় ফিরে আসেন। যোগ দেন ‘দৈনিক জনপদ’ নামে একটি নতুন পত্রিকায়। এইসময় তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হন।

১৯৭৪ সালে ‘দৈনিক জনপদ’ ছেড়ে ‘দৈনিক বঙ্গবার্তা’ যোগ দান করেন। মওলানা ভাসানী সমর্থিত এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহমেদ। প্রায় তিনমাস পর পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে কামাল লোহানী ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ বছরই তার নেতৃত্বে পুনরায় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন নির্বাচনে জয়লাভ করেন।

সরকার ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সংবাদপত্র অ্যানালমেন্ট অধ্যাদেশ জারি করে মাত্র চারটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। কামাল লোহানী তখন সরকারের দেয়া প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানান। এ সময় চাকুরিহারা কামাল লোহানী খুবই অর্থকষ্টে পড়েন।

১৯৭৭ সালে ৬ জানুয়ারি সরকার রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বার্তা’র নির্বাহী সম্পাদক নিযুক্ত করে ঢাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করেন তাকে। ১৯৭৮ সালে তাকে সম্পাদক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। সম্পাদক হবার পর জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকা-তে অনুষ্ঠিতব্য কমনওয়েলথ রাষ্ট্রপ্রধান সম্মেলনে বাংলাদেশের একজন সম্পাদক হিসেবে প্রেসিডেন্সিয়াল এনট্যুরেজের সদস্য মনোনীত হন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের প্রস্তাবনুযায়ী চিরন্তন পরিধেয় পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহার করে স্যুট কোট পরতে অস্বীকার করেন। ফলে সামরিক সচিবের সাথে বাকবিতণ্ডা হয় এবং বিদেশ না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৮১ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সাথে মতবিরোধ হলে ‘দৈনিক বার্তা’ ছেড়ে ‘বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট’ এর প্রকাশনা পরিচালক ও ‘ডেপথনিউজ বাংলাদেশ’-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ক’মাস পরেই তিনি পিআইবি’র এসোসিয়েট এডিটর পদে নিযুক্ত হন।

১৯৯১ সালে তিনি শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ষোল মাসের মাথায় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সাথে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি পিআইবিতে ফিরে আসেন। কিন্তু পিআইবি’র মহাপরিচালক তাকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠান। এই সময় রাজনৈতিক অভিযাত্রার পাশাপাশি যুক্ত হল সংস্কৃতি সংগ্রাম।

চলচ্চিত্রেও দেখা গেছে কামাল লোহানীকে। ঢাকাই প্রথম বাংলা (এফডিসি কেন্দ্রিক) চলচ্চিত্র ফতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আসিয়া’ তে কামাল লোহানী মুখোশ নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এরপর এহতেশাম পরিচালিত ‘এদেশ তোমার আমার’ এ তিনি সমবেত নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন। আজিজুর রহমানের পরিচালনায় ‘পাথরের কান্না’তে অভিনয় করেন কামাল লোহানী, তবে এই চলচ্চিত্র শেষ পর্যন্ত মুক্তিলাভ করেনি।

১৯৭৯ সালে রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত ‘রাজশাহী আর্ট কলেজ’ এর প্রধান উদ্যোক্তাদের অন্যতম কামাল লোহানী ছিলেন ‘রাজশাহী আর্ট কলেজ’ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

কামাল লোহানী ৭২ এর সংবিধান পুণঃপ্রতিষ্ঠা জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যানেরও দায়িত্ব পালন করছেন ।

১৯৮৩ সালে কামাল লোহানী সরাসরি জড়িত হয়ে বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা গঠন করেন এবং গণশিল্পী সংস্থার সভাপতি হন। সবকিছুর পাশাপাশি কামাল লোহানী ‘আমার বাংলা’ নামে শিল্প-সংস্কৃতি গবেষণা ও অনুশীলন চক্র গঠন করেছেন।

এছাড়াও তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার পরিষদের উপদেষ্টা, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটেরও উপদেষ্টা। ১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী ‘ছায়ানট’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মার্কসবাদী আদর্শে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’। দুই দফায় তিনি শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

বর্তমানে তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবাদ বিরোধী দক্ষিণ এশীয় সাংস্কৃতিক কনভেনশনের ওয়ার্কিং গ্রুপের কনভেনার, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর নির্বাহী কমিটির সদস্য, ভাষা আন্দোলনের সংগঠন একুশে চেতনা পরিষদ- এর সাধারণ সম্পাদক, মানবাধিকার নাট্য পরিষদের চেয়ারম্যান ও সোমেন চন্দ চর্চা কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কামাল লোহানী বাংলা একাডেমির একজন ফেলো।

মুক্তিযুদ্ধের সময়

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ-এর পর অবস্থার অবনতিতে অবশেষে এপ্রিলের শেষে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কুমিল্লার চান্দিনা হয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমান্তে পৌঁছেন এবং ঐ স্থানের থানা হাজতে নিরাপদে রাত কাটানোর পরের দিন ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা গিয়ে উপস্থিত হন।

 

আগরতলা থেকে কামাল লোহানী অন্যদের সাথে ট্রেনযোগে কলকাতা যান। যাত্রাসঙ্গী প্রখ্যাত ফুটবলার প্রতাপ শঙ্কর হাজরাদের আত্মীয়ের আমহার্ষ্ট ষ্ট্রীটের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। সেখানে থেকেই কামাল লোহানী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সূত্র খুঁজতে থাকেন। এমন সময় তার সাংবাদিক বন্ধু মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী তাকে ‘জয়বাংলা’ পত্রিকায় নিয়ে যান। ঐখানে কাজ করতে করতে তার সাথে আমিনুল হক বাদশার দেখা হয় বাংলাদেশ মিশনের সামনে।

আমিনুল হক বাদশা অনেকটা ‘হাইজ্যাক’ করার মতো তাকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে নিয়ে যান বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে। সেখানে তখন আয়োজন চলছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’-এর ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার উদ্বোধনের। বালীগঞ্জের এই বাড়িটিতে মন্ত্রীরা (অর্থাৎ প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মন্ত্রীরা) বাস করতেন। তারা বেতারের জন্য বাড়িটি ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। এইখানেই প্রচলিত রীতির যন্ত্রপাতি ও স্টুডিও ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও এই শক্তিধর ট্রান্সমিশনটি উদ্বোধন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে কামাল লোহানী কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন।

আশফাকুর রহমান খান, টি এইচ শিকদার, তাহের সুলতান কেউই প্রকৌশলী ছিলেন না, তবু কোন ভারতীয়র সাহায্য না নিয়েই চালু হয়েছিল এই কেন্দ্রটি। চট্টগ্রামে যারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখনও তারা কেউ পৌঁছাননি। সৈয়দ হাসান ইমাম ‘সালেহ আহমদ’ নামে সংবাদ পাঠ শুরু করেন। সাংবাদিক কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু বিপ্লবী বেতারে কি আর বসে থাকা যায়। যখন যে দায়িত্ব দেয়া হবে, তখন সেটা পালন করতেই হবে। তিনিও সংবাদ বিভাগ সংগঠন করা ছাড়াও সংবাদ পাঠ, কথিকা লেখা ও প্রচার, ঘোষণা, শ্লোগান দেয়া ইত্যাদিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। বিদ্রোহী বেতারে সবাই কর্মী এবং প্রয়োজনে সকলকে সবকিছুই করতে হয়।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে স্বাধীন বাংলা বেতারে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রথম বার্তাটি লিখেছিলেন তিনি এবং বিশ্ববাসীর কাছে সেই বিজয় বার্তা পৌঁছেছিল কামাল লোহানীর উচ্চারণে।

১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার ঢাকা চলে আসবে। এজন্য কামাল লোহানী চলে এলেন ঢাকায়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঢাকা আগমনের ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন কামাল লোহানী।

লেখক জীবন

কামাল লোহানীর লেখা প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে- ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘আমরা হারবো না’, ‘সত্যি কথা বলতে কি’, ‘লড়াইয়ের গান’, ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার’, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার’, ‘এদেশ আমার গর্ব’, ‘মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘যেন ভুলে না যাই’, ‘রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘দ্রোহে প্রেমে কবিতার মত’ প্রভৃতি। এছাড়াও তার ঘটনাবহুল সাংবাদিকতা জীবন সম্পর্কে তার নিজের বাণীকে লেখ্যরূপে প্রেস ইন্সটিটিউট অফ বাংলাদেশ প্রকাশ করেছে ‘অগ্রজের সঙ্গে একদিন’।

সম্মাননা ও পদক:

২০১৫ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদক লাভ করেন কামাল লোহানী। তিনি জাহানারা ইমাম পদক পেয়েছেন ২০০৮ সালে। কলকাতা পুরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা পেয়েছেন তিনি ১৯৯১ সালে। প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সম্মাননা এবং রাজশাহী লেখক সংঘ সম্মাননা পান তিনি। এ ছাড়া ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর ক্রান্তি স্মারক- ২০০৩, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর ঋষিজ সম্মাননা ও স্মারক সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।

মৃত্যু: মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০ জুন (শনিবার) সকালে না ফেরার দেশে চলে গেলেন কামাল লোহানী। সেই সঙ্গে সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতির আকাশে ঘটলো এক নক্ষত্রের পতন।

তথ্যঋণ: তারেক বিন ফিরোজ।





ইতিহাস ও ঐতিহ্য এর আরও খবর

পাইকগাছার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প মৃতপ্রায় ; প্রয়োজন সরকারি পৃষ্টপোষকতা পাইকগাছার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প মৃতপ্রায় ; প্রয়োজন সরকারি পৃষ্টপোষকতা
হারিয়ে যাচ্ছে কবি কাজী কাদের নওয়াজের শেষ স্মৃতি চিহ্ন হারিয়ে যাচ্ছে কবি কাজী কাদের নওয়াজের শেষ স্মৃতি চিহ্ন
চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের জন্মশতবর্ষ পালিত চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের জন্মশতবর্ষ পালিত
চুকনগর বদ্ধভূমি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে : গণপূর্তমন্ত্রী চুকনগর বদ্ধভূমি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে : গণপূর্তমন্ত্রী
ঔপন্যাসিক নীহার রঞ্জন গুপ্তের ১১৩তম জন্মবার্ষিকী পালিত ঔপন্যাসিক নীহার রঞ্জন গুপ্তের ১১৩তম জন্মবার্ষিকী পালিত
জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক নীহার রঞ্জন গুপ্তের ১১৩তম জন্মবার্ষিকী ; নীহার রঞ্জন গুপ্তের বাড়ি সংরক্ষণে ৫ দফা দাবি জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক নীহার রঞ্জন গুপ্তের ১১৩তম জন্মবার্ষিকী ; নীহার রঞ্জন গুপ্তের বাড়ি সংরক্ষণে ৫ দফা দাবি
খুলনায় গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাবাষির্কীতে আলোচনা সভা সঠিক ইতিহাস যেন বিকৃত না হয়  -খুলনায় সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী খুলনায় গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাবাষির্কীতে আলোচনা সভা সঠিক ইতিহাস যেন বিকৃত না হয় -খুলনায় সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন
বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শহীদ এম এ গফুর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শহীদ এম এ গফুর
মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক পাইকগাছার মধুমিতা পার্কটির অবৈধ স্হাপনা উচ্ছেদ করে পূর্বাস্হায় ফেরানোর নির্দেশ মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক পাইকগাছার মধুমিতা পার্কটির অবৈধ স্হাপনা উচ্ছেদ করে পূর্বাস্হায় ফেরানোর নির্দেশ

আর্কাইভ