শিরোনাম:
পাইকগাছা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩১

SW News24
সোমবার ● ১৪ ডিসেম্বর ২০২০
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » ইতিহাসে চির ভাস্বর বুদ্ধিজীবী দিবস
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » ইতিহাসে চির ভাস্বর বুদ্ধিজীবী দিবস
৯৪৫ বার পঠিত
সোমবার ● ১৪ ডিসেম্বর ২০২০
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

ইতিহাসে চির ভাস্বর বুদ্ধিজীবী দিবস

---

প্রকাশ ঘোষ বিধান…

 বুদ্ধিজীবীরা জাতির বিবেক হিসেবে খ্যাত। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দেশের শ্রেষ্ট সন্তানদের হারানোর দিন। বাঙ্গালী জাতীর সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিন।বুদ্ধিজীবীরা তাদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি, যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারকে পরামর্শ প্রদানসহ বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা দিয়ে  মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিতে অসামান্য অবদান রাখেন।বুদ্ধিজীবীরা দেশ-জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির রূপকার। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বলতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় টুকুতেই পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের জ্ঞানী-গুণী ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের হত্যা করাকে বুঝায়।

১৯৭১ সালের রক্তøাত স্বাধীনতা যুদ্ধে চুড়ান্ত বিজয় অর্জনের দুদিন আগে পরাজয় আসন্ন বুঝতে পেরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের এদেশের দোসোরদের সহযোগিতায় ১৪ ডিসেম্বর সন্মুখ সারীর বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের অপহরণ করে নির্মামভাবে হত্যা করে। বাঙ্গালী জাতিকে যখন আর পরাধীন করে রাখা সম্ভব নয় বুঝে এ জাতির মেধাশুন্য করার নির্মাম চক্রান্তে বর্বর পাকিস্তানীরা নারকীয় হত্যাযোজ্ঞ চালায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী বাঙ্গালী জাতির হাজারো শ্রেষ্ট সন্তান শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, গবেষেক, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের চোঁখ বেঁধে বাড়ী ও কর্মস্থল থেকে ধরে নিয়ে তাদের উপর নির্মাম-নিষ্ঠুর নির্যাতন করে হত্যা করে। স্বাধীনতা বিরোধী চক্র বুঝতে পেরেছিল, তাদের পরাজয় অনিবার্য। বাঙ্গালী জাতির শ্রেষ্ট সন্তানরা বেঁচে থাকলে এ দেশের মাটিতে ওরা বসবাস করতে পরবেনা। তাই পরিকল্পিত ভাবে জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গু করতে দেশের এসব বরণ্য ব্যক্তিদের হত্যা করে। ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা এ পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকান্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা। যা বিশ্বব্যাপি শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর রায়ের বাজার সহ বিভিন্ন স্থনে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর আত্মীস্বজনরা মিরপুর, কাটাসুর ও রাজারবাগ বধ্যভূমিতে স্বজনদের লাশ খুজে পায়। বর্বর পাকবাহিনী ও রাজাকারদের পৈশাচিক নির্যাতন বুদ্ধিজীবীদের লাশ জুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন। কারো চোখ, হাত-পা বাধা, কারো কারো শরীরে একাধীক গুলির চিহ্ন আবার অনেককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্য করা হয়েছিল। লাশের ক্ষত-বিক্ষত চিহ্নের কারণে অনেকেই প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেনি।

---

বিজয় দিবসের বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দের রন্ধে রন্ধে ঢুকে পড়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার শোকগাথা। প্রকাশ হতে থাকে বুদ্ধিজীবী হত্যা কাহিনী। ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবীদের বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ডিসেম্বরের এ হত্যাকান্ডে শিকার যারা হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকঃ ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র), ডঃ মুনির চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), ডঃ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), ডঃ আনোয়ার পাশা (বাংলা সাহিত্য),  ডঃ আবুল খায়ের (ইতিহাস),  ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি সাহিত্য), ডঃ সিরাজুল হক খান (শিক্ষা), ডঃ এ এন এম ফাইজুল মাহী (শিক্ষা), হুমায়ূন কবীর (ইংরেজি সাহিত্য), রাশিদুল হাসান (ইংরেজি সাহিত্য), সাজিদুল হাসান (পদার্থবিদ্যা), ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান), এন এম মনিরুজ্জামান (পরিসংখ্যান), এ মুকতাদির (ভূ-বিদ্যা), শরাফত আলী (গণিত), এ আর কে খাদেম (পদার্থবিদ্যা), অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা), এম এ সাদেক (শিক্ষা), এম সাদত আলী (শিক্ষা), সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস), গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস), রাশীদুল হাসান (ইংরেজি), এম মর্তুজা (চিকিৎসক), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকঃ ডঃ হবিবুর রহমান (গণিত বিভাগ), ডঃ শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত), মীর আবদুল কাইউম (মনোবিজ্ঞান),  চিকিৎসকঃ অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ),     অধ্যাপক ডাঃ আলিম চৌধুরী (চক্ষু বিশেষজ্ঞ), অধ্যাপক ডাঃ শামসুদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক ডাঃ আব্দুল আলিম চৌধুরী, ডাঃ হুমায়ুন কবীর, ডাঃ আজহারুল হক, ডাঃ সোলায়মান খান, ডাঃ আয়েশা বদেরা চৌধুরী, ডাঃ কসির উদ্দিন তালুকদার, ডাঃ মনসুর আলী, ডাঃ মোহাম্মদ মোর্তজা,    ডাঃ মফিজউদ্দীন খান, ডাঃ জাহাঙ্গীর, ডাঃ নুরুল ইমাম,  ডাঃ এস কে লালা, ডাঃ হেমচন্দ্র বসাক,    ডাঃ ওবায়দুল হক,  ডাঃ আসাদুল হক,  ডাঃ মোসাব্বের আহমেদ, ডাঃ আজহারুল হক (সহকারী সার্জন), ডাঃ মোহাম্মদ শফী (দন্ত চিকিৎসক), শহীদুল্লাহ কায়সার (সাংবাদিক), নিজামুদ্দীন আহমেদ (সাংবাদিক), সেলিনা পারভীন (সাংবাদিক), সিরাজুদ্দীন হোসেন (সাংবাদিক), আ ন ম গোলাম মুস্তফা (সাংবাদিক), আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সুরকার), ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রাজনীতিবিদ), রণদাপ্রসাদ সাহা (সমাজসেবক এবং দানবীর), যোগেশ চন্দ্র ঘোষ (শিক্ষাবিদ, আয়ূর্বেদিক চিকিৎসক), জহির রায়ান (লেখক, চলচ্চিত্রকার), মেহেরুন্নেসা (কবি), ডঃ আবুল কালাম আজাদ (শিক্ষাবিদ, গণিতজ্ঞ), নজমুল হক সরকার (আইনজীবী), তুন চন্দ্র সিংহ (সমাজসেবক, আয়র্বেদিক চিকিৎসক)। একাত্তরের সাংস্কৃতিক রাজাকাররা তৈরী করেছিল বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযোদ্ধে সক্রিয় বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। সেই তালিকা তারা তুলে দিয়েছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর হাতে। তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে দেশের সেরা মেধারীদের ধরে নিয়ে যায় অলা-বদর সদস্যরা মহাম্মদপুরে অবস্থিত ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে তারা তৈরী করেছিল টর্চার সেল। পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়।

১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, প্রকাশিত সংবাদ ও আর্ন্তজাতিক ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’ এর  সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানাগেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবী সংখ্য ১ হাজার ৭০ জন। আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানাগেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সারাদেশে মোট ৯৬৮ জন শিক্ষবিদ, ২১ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ৪১ জন আইনজীবী সহ ১ হাজার ২০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। ৪২ বছরপর বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই মূল খুনি বলে দায়ি হয়েছেন আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীন। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধে চুড়ান্ত বিজয়ের ঊষালগ্নে ১৮জন বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে তাদের ২ জনকে একসঙ্গে দায়ি করে মামলা রায় দেয়া হয়েছে। তারা নির্মম ভাবে হত্যা করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষক, ৬ জন সাংবাদিক ও ৩জন চিকিৎসককে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত হয় বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধ। এটি মিরপুরে অবস্থিত। স্মৃতিসৌধটির স্থপতি মোস্তফা হালি কুদ্দুস। ঢাকা রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে নাম জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীদের সম্মানে নির্মান করা হয়েছে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ’ স্থপতি মোঃ জামী-আল-সাফী ও ফরিদউদ্দীন আহম্মদের নকশায় নির্মিত। ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে বর্তমান প্রধান মন্ত্রী ও তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিসৌধটি উদ্ভধন করেন। বাংলাদেশ ডাক বিভাগও বুদ্ধিজীবী স্মরণে একটি স্মারক ডাক টিকিটের সিরিজ বের করেছে। প্রতি বছর  বুদ্ধিজীবী স্মরণে ১৪ ডিসেম্বর দিবসটি পালন করা হয়। বুদ্ধিজীবীদের এ সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।

লেখকঃ সাংবাদিক।





আর্কাইভ