রবিবার ● ১৬ মে ২০২১
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » হলুদ সাংবাদিকতার খেসারত
হলুদ সাংবাদিকতার খেসারত
প্রকাশ ঘোষ বিধান……..
সাংবাদিকতার আলোচনায় বর্তমান সময়ে হলুদ সাংবাদিকতা শব্দটি আতঙ্কের।হলুদ সাংবাদিকতা বলতে উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে ভিত্তিহিন রোমাঞ্চকর সংবাদ প্রকাশ বা উপস্হাপনাকে বুঝায়। আবার অতির জ্ঞিত সাংবাদিকতাকে হলুদ সাংবাদিকতা বলা হয়।
সাংবাদিকতার রীতিনীতি না মেনে ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করা,দৃস্টি আকর্ষনকারী শিরোনাম ব্যবহার করা, অহেতুক চমক সৃস্টি করা,কেলেংকারির খবর গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা আবার কোন গুরুত্বপূর্ণঘটনা প্রচার না করে এড়িয়ে যাওয়া হলুদ সাংবাদিকতার কাজ বলে বিবেচিত হয়।অকেজো,নস্ট,খারাপ কোন বস্তুকে বোঝানোর জন্য সাধারণত হলুদ রং এর প্রতিক ব্যবহার করা হয়।সোনায় যেমন খাদ আছে,তেমনি সাংবাদিকতায় আছে অপসাংবাদিকতা।আর এই অপসাংবাদিকতার রং বা প্রতিক হয়েছে ইয়েলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা।
সাংবাদিকতায় ইয়েলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা শব্দটি এসেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম দুই ব্যক্তিত্ব যুক্তরাস্টের জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম হার্স্টের মধ্যে পেশাগত এক অশুভ প্রতিযোগিতার ফসল আজকের এই ‘হলুদ সাংবাদিকতা’।
উইলিয়াম হার্স্ট ১৮৮২ সালে ‘দ্য জার্নাল’ নামে একটা পত্রিকা কিনে নেন জোসেফ পুলিৎজারের ভাই অ্যালবার্ট পুলিৎজারের কাছ থেকে। কিন্তু পরিবারের সদস্যের পত্রিকা হার্স্টের হাতে চলে যাওয়ার বিষয়টিকে সহজ ভাবে নিতে পারেন নি পুলিৎজার।শুরু হয় হার্স্টের সাথে পুলিৎজারের স্নায়ুযুদ্ধ।
১৮৮৩ সালে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড নামে একটি সংবাদপত্র কিনেন প্রখ্যাত সাংবাদিক জোসেফ পুলিৎজার। পত্রিকাটির আগের মালিক ছিলেন জে গোল্ড।শুরু হয় হার্স্টের সাথে পুলিৎজারের স্নায়ুযুদ্ধ।
পুলিৎজার নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড কিনেই ঝুঁকে পড়লেন চাঞ্চল্যকর খবর, চটকদারি সংবাদ ইত্যাদি প্রকাশে। রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্ট নামে একজন কার্টুনিস্টকে চাকরি দিলেন তার কাগজে। ওই কার্টুনিস্ট ‘ইয়েলো কিড’ বা ‘হলুদ বালক’ নামে প্রতিদিন নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের প্রথম পাতায় একটি কার্টুন আঁকতেন এবং তার মাধ্যমে সামাজিক অসংগতি থেকে শুরু করে এমন অনেক কিছু বলিয়ে নিতেন, যা ছিল অনেকটাই পক্ষপাতদুষ্ট।
এক সময় হার্স্ট পুলিৎজারের নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের কার্টুনিস্ট রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্টকে অধিক বেতনের প্রলোভনে নিয়ে এলেন তার ‘জার্নাল’ পত্রিকায়। হার্স্ট তাতেই ক্ষান্ত থাকেননি, মোটা বেতনের লোভ দেখিয়ে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের ভালো সব সাংবাদিককেও টেনে নেন নিজের পত্রিকায়। এতে পুলিৎজার রেগে আগুন। তিনি অগত্যা জর্জ চি লুকস নামে আরেক কাটুনিস্টকে নিয়োগ দেন।এদিকে জার্নাল, ওদিকে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড – দুটো পত্রিকাতেই ছাপা হতে লাগলো ইয়োলো কিডস বা হলুদ বালক কার্টুন। শুরু হয়ে গেলো পত্রিকার কাটতি নিয়ে দুটো পত্রিকার মধ্যে দ্বন্দ্ব। জার্নাল এবং নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের বিরোধ সে সময়কার সংবাদপত্র পাঠকদের কাছে ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিলো।
দুটো পত্রিকাই তাদের হিট বাড়ানোর জন্য ভিত্তিহীন, সত্য, অর্ধসত্য ব্যক্তিগত কেলেংকারিমূলক খবর ছাপা শুরু করলো। এতে দুটো পত্রিকাই তাদের মান হারালো। তৈরী হলো একটি নষ্ট মানসিকাতর পাঠকশ্রেণি, যারা সব সময় চটকদার, ভিত্তিহীন, চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী, অর্ধ-সত্য সংবাদ প্রত্যাশা করতো এবং তা পড়ে তৃপ্তি পেতো।
১৮৯০ সাল নাগাদ প্রযুক্তির এগিয়ে যাওয়ায় নিউ ইয়র্কের পত্রিকা মালিকেরা নিজেদের মাঝে লড়াইয়ে নামলেন, যে যত দাম কমিয়ে ক্রেতা বাড়াতে পারেন। সংবাদপত্রগুলোকে দিন দিন সস্তা করে তুলছিল। কিন্তু এর মাঝে জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম হার্স্টের লড়াই মনে রাখার মতো। দুটো পত্রিকাকেই খদ্দের ধরতে খবরে রঙ চড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত করা হতো, যদিও তারা ভালো রিপোর্টিংও কম করেনি ।
এভাবেই জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম হার্স্ট দু’জনেই হলুদ সাংবাদিকতার দায়ে অভিযুক্ত এবং ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে রইলেন। হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান সাংবাদিক জোসেফ পুলিৎজাররে জন্ম ১৮৪৭ সালের ১০ এপ্রিল। অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধ থেকে ঊনবিংশ শতকের সূচনালগ্ন পর্যন্ত তিনি ছিলেন একাধারে সফলতম লেখক ও সংবাদপত্র প্রকাশক। সাংবাদিকতা ও লেখালেখির মাধ্যমে তার আয় করা বিপুল অর্থ ও ধন-সম্পদ তিনি দান করে গেছেন কলম্বিয়া স্কুল অব জার্নালিজমে। বর্তমানে এটি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তার ইচ্ছে অনুযায়ী ১৯১১ সালের ২৯ অক্টোবর তার মৃত্যুর পর তার সম্মানার্থে পুলিৎজার পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। সাংবাদিকতা ও আলোকচিত্রকলা, নাটক, কবিতা, ইতিহাস, পত্র, সংগীতের মতো ২১টি বিভাগে এ পুরস্কার সাংবার্ষিক আকারে দেয়া হয়। সাংবাদিকতার বড় এক স্বীকৃতি ও সম্মানজনক পুরস্কার পুলিৎজার।
হলুদ সাংবাদিকতার সাথে তার নাম জড়িত থাকলেও ১৮৮০-এর দশকে পুলিৎজার নতুন সাংবাদিকতার কলা-কৌশল প্রবর্তন করে বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেন। যা তাকে করেছে অমর। অনেকেই তাকে সাংবাদিকতার পিতামহও বলে আখ্যায়িত করেছেন।
১৯৪১ সালে ফ্রাংক মট হলুদ সাংবাদিকতার পাঁচটি লক্ষণের কথা বলেছিলেন। এর মাঝে আছে বিশাল অক্ষরে ছাপা শিরোনাম, যা মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়, নিশ্চয় সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে, অথচ তেমন কিছুই না। যেসব সংবাদে অনাবশ্যকভাবে বেশি বেশি ছবি ব্যবহার করা হয়, যেখানে মিথ্যা সাক্ষাৎকার দেয়া হয়, কুসংস্কারকে বিজ্ঞান বলে দাবী করা, ভুল তথ্য দিয়ে ‘গবেষণায় পাওয়া যায়’ বা ‘বিশেষজ্ঞরা মনে করেন’ বলে দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় রঙের ব্যবহার।
ভালোর সাথে মন্দ ছায়ার মতন লেগে থাকে।সকল পেশায় কিছু দুস্ট প্রকৃতির লোক রয়েছে। সাংবাদিকতায়ও কিছু দুস্টু সাংবাদিক আছে।তাদের দুস্টু কাজের কারণে এই মহান পেশার লোকের বদনাম হচ্ছে।
দেশে অনেক গুণী,প্রথিতযশা সুশিল সাংবাদিক আছেন।এ সমাজে তারা শ্রদ্ধা ও ভক্তির পাত্র।তাদের ক্ষুরধার লেখনীতে বদলে যায় সমাজের নানা অসংগতির চিত্র।কিন্ত সাংবাদিকতার আড়ালে তথ্য সন্ত্রাসের জন্মদাতা হলুদ সাংবাদিকতা ক্রমেই বিষিয়ে তুলেছে সমাজ ও সমাজে বসবাসকারী মানুষদের ।তাদের জীবন হচ্ছে নিস্পেষিত।সাংবাদিকতার অন্তরালে হলুদ সাংবাদিকতার তথ্য সত্রাসের আগ্রাসন ঠেকাতে না পারলে সমাজকে বড় খেসারত দিতে হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক