শুক্রবার ● ১ অক্টোবর ২০২১
প্রথম পাতা » উপ-সম্পাদকীয় » মূর্তি পূজা নয় প্রতিমা পূজা
মূর্তি পূজা নয় প্রতিমা পূজা
প্রকাশ ঘোষ বিধান=
সনাতন ধর্মে প্রতিমা পূজা আরাধনার সূচনাপর্বের বিষয়। প্রথমেই জানা দরকার পূজা শাব্দিক অর্থে “মূর্তি পূজা” নয়, বরং এর উচ্চারণ হবে “প্রতিমা পূজা”আমরা কখনই মূর্তিকে পূজা করি না। মূর্তির মধ্য প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাকে ঈশ্বর জ্ঞানে প্রতিমা পূজা করি। প্রতিমার মাধ্যমে ঈশ্বরের পূজা করার অর্থ হল ঈশ্বরের প্রতি নিজের বিশ্বাসকে দৃঢ় করা।
প্রতিমা বা আইকন (গ্রীক শব্দ আইকন যার অর্থ ছবি বা প্রতিচ্ছায়া) হছে এক ধরনের ধর্মীয় শিল্প। প্রতিমূর্তি, প্রতিকৃতি ঈশ্বরের কোনো রূপের সাদৃশ্যকল্পনায় গঠিত বা নির্মিত দেবমূর্তি। প্রতিমান, প্রতিবিম্ব, প্রতিমা, প্রতিয়াতনা, প্রতিচ্ছায়া, প্রতিকৃতি, অর্চা, প্রতিনিধি। বৈদিক অভিধান অনুসারে এই আট নামেই প্রতিমার শব্দ।
অনেকে প্রশ্ন করে বেদে উল্লেখ নেই তবুও কেন প্রতিমা পূজা করি আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। আমরা বেদে প্রতিমা পূজার উল্লেখ দেখতে পাইনা। বেদ যখন রচিত হয় তখন মানুষের মধ্যে তেমন কোন বিভিন্নকর্ম চঞ্চলতা ছিল না। যজ্ঞানুষ্ঠানই ছিল ঋষিদের প্রধান কর্ম। যজ্ঞের মাধ্যমে হোমানল জ্বালিয়ে তখন দেবতাদের আহ্বান করা হত, অগ্নির মাধ্যমেই দেবতাদের উদ্দেশ্য দেওয়া হতো পুষ্পাঞ্জলি।
এই কলিযুগে সনাতন ধর্মে নিরাকার উপাসনা প্রায় অসম্ভব। কারণ, কলি যুগে আমাদের আয়ু অল্প, কলহ প্রিয়, অলস, মন্দগতি, ভাগ্যহীন, বিভিন্ন রোগাদি দ্বারা আক্রান্ত ও দুষ্ট মন এতই চঞ্চল যে একে নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। মনকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি সহজ উপায় হচ্ছে, চোখের মধ্য কোন বস্তুর ছবি ফেলা। পরবর্তীতে, ওই ছবিটি যদি নাও থাকে তবে চোখের সামনে তার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠবে। তাই, সাধারন মনোনিবেশ তথা চিত্তকে বিষয় বাসনা থেকে সরিয়ে একাগ্রচিত্তে ভগবানকে স্মরণ করার জন্য প্রতিমা পূজ। একটি বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি। যেমন একটি শিশুকে প্রথম পাঠদানের সময় অনেক রঙিন ছবি সম্বলিত বই দেওয়া হয় যাতে ঐ বইটির প্রতি শিশুর আকর্ষণ বাড়ে। এখানে ছবি মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে বর্ণমালা। ঠিক তেমনি আমাদের চঞ্চলমন প্রতিমার মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এখানে, ঈশ্বরের করুণা লাভই হচ্ছে মুখ্য বিষয়।
আমাদের আদি ধর্ম গ্রন্থ বেদে নিরাকার উপাসনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, কলিযুগে জীবের পারমার্থিক উন্নতির উদ্দেশ্য গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের মধ্যে এই আলোচনা হয়েছে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে প্রশ্ন করছে, নিরাকার উপাসনা ও সাকার উপাসনার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম কোনটি।
”এবং সততযুক্তা যে ভক্তাস্তাং পর্যুপাসতে, যে চাপ্যক্ষরমব্যক্তং তেষাং কে যোগবিত্তমঃ” অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন এভাবেই নিরন্তর ভক্তিযুক্ত হয়ে যে সমস্ত ভক্তেরা যথাযথভাবে তোমার (সাকার) আরাধনা করেন এবং যাঁরা ইন্দ্রয়াতীত অব্যক্ত ব্রহ্মের (নিরাকার) উপাসনা করেন, তাদের মধ্যে কারা শ্রেষ্ঠ যোগী।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উত্তরে বললেন, ”ময্যাবেশ্য মনো যে মাং নিত্যযুক্তা উপাসতে, শ্রদ্ধয়া পরয়োপেতাস্তে মে যুক্ততমা মতাঃ” যাঁরা তাদের মনকে আমার সবিশেষ রুপে নিবিষ্ট করেন এবং অপ্রাকৃত শ্রদ্ধা সহকারে নিরন্তর আমার (সাকার) উপাসনা করেন, আমার মতে তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।
অব্যক্ত উপাসনা দেহাভিমানী জীবের পক্ষে সম্ভবপর নয়। দেহাভিমানী জীবের জন্য সগুণ সাকার উপাসনাই শ্রেষ্ঠ ও সহজতর। আর এইসকল কারনেই, বর্তমান কলিযুগে আমরা হিন্দুরা প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করে ভগবানের বিগ্রহ পূজা করি। প্রতিমা পূজা হলো প্রতীকের মাধ্যমে বিশেষভাবে প্রার্থনা করা। আমরা যা করি তা অনেকটাই প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকি। প্রতীক বা মাধ্যম ভিন্ন কোন ভাবের আদান প্রদান করা যায় না। যেমন জ্ঞানের প্রতীক অক্ষর, প্রার্থনার প্রতীক মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা ইত্যাদি। এই শ্রদ্ধাটাই হলো পূজা। এগুলোর মধ্যে সৃষ্টিকর্তার যে অলৌকিক শক্তি ও সম্পর্ক আছে মানুষ তাকেই শ্রদ্ধা জানায় বা আহ্বান করে। মানুষ বিশেষভাবে শ্রদ্ধার সাথে সৃষ্টিকর্তার সেই শক্তির আহ্বান করাকেই পূজা বলে। পূজা অর্থ বিশেষ ভাবে শ্রদ্ধা জানানো।
স্বামী বিবেকানন্দ তাই মূর্তি পূজা সম্পর্কে বলেছেন - কারো পিতার ছবি দেখলে যেমন পিতার কথা মনে পড়ে, তেমনি ভগবানের ছবি দেখলে ভগবানের কথাই মনে পড়ে এবং তখনই মন পবিত্র হয়। যেমন প্রতীক ভিন্ন অন্য কোথাও ভোট দেয়া হয় না তেমনি আমরা কোন ছবি, কাগজ বা প্রতীককে পূজা করি না, পূজা করি তার গুণ ও আদর্শকে।
লেখকঃ সাংবাদিক।