শুক্রবার ● ২৯ অক্টোবর ২০২১
প্রথম পাতা » সুন্দরবন » ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে জেলেদের সমুদ্রযাত্রা
ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে জেলেদের সমুদ্রযাত্রা
এস ডব্লিউ নিউজ: ১লা নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে দুবলার চরের শুঁটকি মৌসুম ।জীবনের ঝুঁকি ও ঋণের বোঝা নিয়ে মৎস্য আহরণে সমুদ্রে যাত্রা করছে জেলারা। করোনায় মানবতার জীবন যাপন করতে থাকা জেলেরা সমুদ্রে মৎস্য আহরণকে ঘিরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে । ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় জীবনের ঝুকি নিয়ে চলেছে উপকূলের জেলে-মহাজনেরা। সাগরে যেতে যে যার মত প্রস্তুত করছেন জাল, দড়ি, নৌকা-ট্রলার। কেউ কেউ গড়ছেন নতুন ট্রলার, আবার কেউ পুরাতন নৌকা মেরামত করে নিয়েছেন। প্রস্তুতি অনুযায়ী অনেকেই আগেভাগে রওনা দিচ্ছেন।খুলনা জেলার মধ্যে পাইকগাছা উপজেলা থেকে সব সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জেলেরা দুবলার চরে মাছ আহরণ করতে যান। মৌসুমের শুরুতে দাদনদারদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে জেলারা তৈরী করেন মাছ ধরার বহর। এবছর উপজেলার বোয়ালিয়া, হিতামপুর, মাহমুদকাটী, নোয়াকাটি, কপিলমুনি, কাটিপাড়া, রাড়ুলী, শাহাপাড়া, বাঁকাসহ বিভিন্ন গ্রামের জেলে পল্লী থেকে অন্তত আড়াই’শ ট্রলার সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে।
দুবলার চর বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের দক্ষিণে, কটকার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং হিরণ পয়েন্টের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি দ্বীপ যা চর নামে হিন্দুধর্মের পূণ্যস্নান, রাসমেলা এবং হরিণের জন্য বহুল পরিচিত। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে এটি একটি বিচ্ছিন্ন চর। এই চরের মোট আয়তন ৮১ বর্গমাইল। আলোরকোল, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকিল্লা, অফিসকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয় এবং মেহের আলির চর নিয়ে দুবলার চর গঠিত।
দুবলার চরে তৈরি হয় জেলে গ্রাম। মাছ ধরার সঙ্গে চলে শুঁটকি শোকানোর কাজ। বর্ষা মৌসুমের ইলিশ শিকারের পর বহু জেলে চার মাসের জন্য সুদূর কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা থেকে ডেরা বেঁধে সাময়িক বসতি গড়ে সেখানে। মেহেরআলীর খাল, আলোরকোল, মাঝেরচর, অফিসকেল্লা, নারিকেলবাড়িয়া, মানিকখালী, ছাফরাখালী ও শ্যালারচর ইত্যাদি এলাকায় জেলে পল্লী স্থাপিত হয়। এই চার মাস তারা মাছকে শুঁটকি বানাতে ব্যস্ত থাকেন। এখান থেকে শুঁটকি চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের পাইকারী বাজারে মজুদ ও বিক্রয় করা হয়।
সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগ থেকে মাছ সংগ্রহের অনুমতি সাপেক্ষে বহরদার ও জেলেরা দুবলার চরে প্রবেশ করে থাকেন। দুবলার চর থেকে সরকার নিয়মিত হারে রাজস্ব পেয়ে থাকে। প্রতি বছর বিএলসি বা বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট, ডিএফসি বা ডেইলি ফুয়েল (জ্বালানি কাঠ) কন্যাম্পশন ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় বন বিভাগকে রাজস্ব প্রদান করে মৎস্য ব্যবসায়ীগণ সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি পান, এছাড়া আহরিত শুঁটকি মাছ পরিমাপ করে নিয়ে ফিরে আসার সময় মাছভেদে প্রদান করেন নির্ধারিত রাজস্ব।
জানা গেছে, ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা শুটকি পল্লীর কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে মগ বা সন্দীপ ও চট্রগ্রামের উপকূলীয় জেলেরা সুন্দরবনের চরে অস্থায়ী বাসা তৈরি করে মৎস্য আহরণ করতো। আশির দশক থেকে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা ও পটুয়াখালীর জেলেরা সুন্দরবন এলাকায় শুটকির জন্য বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণ শুরু করেন। সেই থেকে নানান প্রতিকূলতার মধ্যে জেলেরা মৎস্য আহরণ করে আসছে। ডাঙ্গায় বাঘ, জলে কুমির-হাঙ্গর, বনদস্যু-জলদস্যুর উৎপাত ও বণরক্ষীদের হয়রানির মধ্যেও তাদের পেশা টিকিয়ে রেখেছেন।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে ৭ হাজার ৩২৫ জন শুটকি পল্লীর জেলেদের কাছ থেকে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার ৮১৯ টাকা বনবিভাগ রাজস্ব আদায় করেন। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ৭ হাজার ৭৮৭ জন শুটকি পল্লীর জেলেদের কাছ থেকে ২ কোটি ৭৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪৮ টাকা সরকারিভাবে আদায় করা হয়েছে। যা বিগত বছরের তুলনায় বেড়ে ২৭ লাখ টাকারও বেশী রাজস্ব আদায় হয়েছে। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। এবারও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সমপরিমাণ কিংবা তার চেয়ে বেশী রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে বলে বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে। সরকার ও বনবিভাগের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা, সুন্দরবনের দস্যুমুক্ত করায় ও বনবিভাগের অসাধু সদস্যদের হয়রানি কিছুটা বন্ধ হওয়ায় এবং নজরদারি বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরবন ও উপকূলীয় শুটকি পল্লী থেকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
খুলনা জেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে পলি জমে ভরাট হওয়ায় শুধুমাত্র সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে ও নানা প্রতিকূলতায় ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে পারেনি জেলে পরিবারগুলো। বরং দিন দিন তাদের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ক্রমবর্ধমান ক্ষতির মুখে ইতোমধ্যে পূঁজি ও জাল-নৌকা হারিয়ে পেশা হারিয়েছেন অনেকে। আবার অনেকে চড়াহারে মহাজনদের সুদের মাশুল গুণে এ পেশায় টিকে থাকার জন্য কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ তফশীলি ব্যাংক থেকে জেলেদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করার কথা থাকলেও বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেওয়ায় তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়।
বোয়ালিয়া জেলে পল্লীর বাসিন্দা শিতেনাথ বলেন, প্রতি বছর আমরা বিভিন্নভাবে ঋণ করে সমুদ্রে যাই। সরকারিভাবে আমরা তেমন কোন সাহায্য সহযোগীতা পাই না। সুন্দরবনে জলদস্যু-বনদস্যুর উৎপাত ও মুক্তিপণ আদায়সহ আসাধু বনরক্ষীদের দৌরাত্ম্য কিছুটা বন্ধ হলেও এখনও সীমাহীন সমস্যায় মধ্যে থাকতে হয় আমাদের।
ক্ষোভ প্রকাশ করে জেলেরা বলেন, আমরা প্রতিবছর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র থেকে মাছ ধরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব সরকারকে দেই। কিন্তু আমরা সহজ শর্তে কোন ঋণ পাই না। জেলেদের সকল সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণসহ ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানান।
এ বিষয়ে সেভ দ্যা সুন্দবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ লায়ন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, সুন্দরবন আমাদের প্রকৃতিক রক্ষা কবজ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মায়ের মত আগলে রেখেছে। কিন্তু আমাদের লোভের বলি হয়ে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ এ সুন্দরবন। এ বনকে রক্ষা না করলে আগামীতে এ এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে বিপন্ন হতে পারে। এজন্য বনের বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম রক্ষায় সরকারি বেসরকারিভাবে সকলকে সমান উদ্যোগ গ্রহণ করে এগিয়ে আসতে হবে। জেলেরা যাতে বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করে শুটকির জন্য মৎস্য আহরণ করতে পারে সেজন্য বনবিভাগের ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের দাবি জানান তিনি।