বৃহস্পতিবার ● ৯ ডিসেম্বর ২০২১
প্রথম পাতা » ইতিহাস ও ঐতিহ্য » ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবস
৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবস
এস ডব্লিউ; আজ ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবস। ১৯৭১ এ এই দিনে কপিলমুনি রাজাকার মুক্ত হয় । স্বাধীনতাকামী মুক্তি পাগল দামাল ছেলেদের এলাকা ভিত্তিক ও ধারাবাহিক বিজয়ের উষ্ণতায় অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে নুতন দেশ হিসেবে লাল-সবুজের বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়।
কপিলমুনি রাজাকার ঘাটি ছিল দূর্ভেদ্য। প্রায় ২০০ জন রাজাকার ছিল সার্বক্ষণিক সশস্ত্র অবস্থান। আধুনিক কপিলমুনির রুপকার বিনোদগঞ্জ প্রতিষ্ঠাতা রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর বাস ভবনটি ছিল রাজাকার দূর্ভেদ্য ঘাটি। চারিদিকে উচু প্রাচীর, সুরম্য দ্বিতল ভবন থেকেই পাইকগাছা, তালা ও ডুমুরিয়ার একটি অংশ পরিচালিত হতো এই ঘাটি থেকে। জোর পূর্বক গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী ধরে এনে ঘাটিতে উৎসবে মেতে থাকাই ছিল নিত্য নৈমিক্তিক ব্যাপার। সুরক্ষিত বিনোদ ভবনে বসেই গ্রহন করা হতো সকল পরিকল্পনা। এলাকাটিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস বেশী থাকায় তাদের উপর চালানো হয়েছিল অমানুষিক নির্যাতন, লুট করা হয়েছিল ধন-সম্পদ, এমনকি জোর করে অনেককে হিন্দু ধর্ম থেকে মুসলমান ধর্মে দিক্ষীত করা হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে ধরে এনে নিরীহ মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করা হতো। লালসার শিকার হয়েছিল অগনিত মা-বোন। নির্যাতনের মাত্রা এতোটা ভয়াবহ ছিল যে সেটির বনর্ণা দিতে গিয়ে আজো অনেকে গা শিহরে উঠে। মানুষ ধরে এনে জীবন্ত শরীরে পেরেক ঠুকে দেয়ালে গেঁথে রাখা হতো। হাত-পা চিরে লবন ছিটানো হতো। বড় বড় ইট দিয়ে শরীরে আঘাত করে হত্যা করা হতো। হত্যার পর গোপন সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে লাশ কপোতাক্ষ নদে ফেলে দেয়া হতো। তাদের এমন অত্যাচারে এলাকার মানুষের জানমাল হয়ে উঠে দূর্বিষহ।
এমতাবস্থায় ১১ জুলাই লেঃ আরিফেনের নেতৃত্বে কপিলমুনির এই রাজাকার দূর্ভেদ্য ঘাটিত প্রথম আক্রমন চালানো হয় কিন্তু কোন সফলতা না পাওয়ায় পরবর্তীতে তালা থানা এলাকার নক্সালদের সমবেত প্রচেষ্টায় আরেকবার আক্রমন চালানো হলে আশানুরুপ ফল না হওয়ায় রাজাকারদের মনোবল বহুগুনে বেড়ে যায়। শত্রু মনে করে যাকে তাকে ধরে কৃষ্ণচুড়া ফুলতলায় (বধ্যভূমিতে নির্মীত স্মৃতি সৌধ) নিয়ে প্রকাশ্য গুলি করে মেরে কপোতাক্ষে ফেলে দিতে থাকে। কপিলমুনির এই শক্ত রাজাকার ঘাটি আক্রমনের মহা পরিকল্পনা গ্রহন করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ৭ ডিসেম্বর, রাত প্রায় ১২টায় আতংকগ্রস্থ মানুষ ঘর ছেড়ে বন জঙ্গলে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে আছে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা, কোলাহল মুক্ত পরিবেশ, যেন ভুতুড়ে এলাকা। এরি মধ্যে দূর্ভেদ্য রাজাকার ঘাটিতে চারিদিক থেকে শুরু হয়ে গেছে গাজী রহমত উল্লাহ দাদু’র নেতৃত্বে স.ম বাবর আলী, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, ইউনুস আলী ইনু, স.ম আলাউদ্দীন, ইঞ্জিঃ শেখ মুজিবর রহমান, মোড়ল আব্দুস সালাম, শেখ আব্দুল কাইয়ুম, আবুল কালাম আজাদ, সাহিদুর রহমান কুটু, গাজী আনছার আলী, আনোয়ার হোসেন, তোরাব হোসেন, আবু বাক্কার, শাহাজাহান, আব্দুস শুকুর, গফুর মোড়ল, মইনুল ইসলাম, ক্ষিতীশ মন্ডল, আব্দুল লতিফ, বিনয়, তৌফিক, সবুর, ফারুক, খালেক, মন্টু, বাচ্চু, বাবু, মোশারফ, রবিউল, বজলু, হুমায়ুন, কামরুল, ইসলাম বন্দ, শফিক, আবুল, জাফর, খোকা, আজিজ, রশিদ, মকবুল, জিল্লুসহ নাম না জানা আরো অনেক মুক্তি পাগল দামাল ছেলেদের সাড়াশি আক্রমন। সুনিপুন পরিকল্পনা, তিনদিন তিনরাত একটানা সশস্ত্র যুদ্ধ ও দু’জন বীর শহীদের (আনোয়ার ও আনছার) জীবনের বিনিময়ে মুক্ত হয় কপিলমুনি। এক পর্যায়ে কুখ্যাত রাজাকাররা অস্ত্র ঘাটিতে রেখে হাত উঁচু করে লাইন দিয়ে বেরিয়ে সহচরী বিদ্যা মন্দির মাঠে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্ম সমর্পন করে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মূহুর্তের মধ্যে এলাকার মানুষ উক্ত মাঠে জড়ো হয়। নির্যাতিত ও স্বজন হারা মানুষ চড়াও হতে থাকে রাজাকারদের উপর। এর মধ্যে রাজাকার ঘাটি থেকে তাদের ব্যবহৃত অস্ত্র আনতে গিয়ে উদ্ধার হয় দেয়ালে পেরেক গাঁথা একটি বিভৎস্য লাশ। পার্শ্ববর্তী তালা থানার খলিলনগর ইউনিয়নের মাছিয়াড়া গ্রামের রহিম বক্স গাজীর পুত্র সৈয়দ আলী গাজীকে মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর সন্দেহে ধরে এনে এভাবে হত্যা করা হয়। এ খবর তাৎক্ষনিক বিদ্যা মন্দিরের মাঠে পৌছালে হাজার হাজার উপস্থিত জনতা উত্তেজিত হয়ে উঠে রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শ্লোগান দিতে থাকে। এ সময় যুদ্ধকালীণ কমান্ডাররা একমত হয়ে উপস্থিত জনতার কাছে রাজাকারদের শাস্তির রায় সম্পর্কে জানতে চান। জনতার রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ও রায় কার্যকর করতে গঠন করা ট্রাইবুনাল কোর্ট। যার চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ কামরুজ্জামান টুকু ও অন্য সকলে সদস্য। জনতার বাছাইকৃত ১১জনকে জীবিত অবস্থায় শরীরের বিভিন্ন অংশে বেওনেট দিয়ে চিরে লবন ছিটিয়ে রোদে ফেলে রেখে এবং সকলের শেষে ওদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঐদিন ১৫৫জন রাজাকারের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। দেশের অন্য কোথাও এক সাথে এত রাজাকার মারার নজির নেই। কপিলমুনির যুদ্ধ ছিল ’৭১ -এর মুক্তিযুদ্ধে এক ব্যতিক্রর্মী অধ্যায়।
দীর্ঘদিনের দাবীর প্রেক্ষিতে কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধে বীরমুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ আনোয়ার ও গাজী আনছারসহ অত্র এলাকার ডাঃ ফনিন্দ্র নাথ, উমাপদ নাথ, চৈতন্য পালসহ (রাজাকারদের হাতে নিহত) নাম না জানা অগনিত শহীদদের স্মরণে ও তাদের রক্তে প্রবাহমান কপোতাক্ষ তীরে কৃষ্ণচুড়া ফুলতলায় বধ্যভূমিতে সরকারী অর্থায়নে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে।
২০২০সালে ৯ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবস সাড়ম্বরে পালিত হয়। সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, স্থানীয় এমপি আলহাজ্ব মোঃ আকতারুজ্জামান বাবু, দু’জন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন ও তপন কান্তি ঘোষ উপস্থিতি থেকে কপোতাক্ষ তীরবর্তী বাইপাস সড়কের পাশে ’কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স’ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ২ কোটি টাকা বরাদ্দের এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ছাড় পত্র দেয়া হলেও জায়গা সর্ম্পকীত জটিলতায় এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও জমির মালিকানা দাবীদারদের ইঁদুর বিড়াল খেলায় লিপ্ত হবার কারণে ঠিকাদার কাজ শুরু করতে পারেনি, ফলে ১টি বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পের টাকা ফেরত যাবার আশংকা দেখা দিয়েছে।
শহীদ আনোয়ার ও আনছার ছাড়াও কপিলমুনি যুদ্ধে অংশ গ্রহনকারী বীরমুক্তিযোদ্ধা গাজী রহমাতুল্লাহ দাদু, শেখ আব্দুল কাইয়ুম, মোড়ল আব্দুস সালাম, ক্ষিতীষ মন্ডলসহ নাম না জানা যারা ইতিমধ্যে না ফেরার দেশে চলে গেছেন তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করাসহ গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে পাইকগাছাবাসী ।