রবিবার ● ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২
প্রথম পাতা » মুক্তমত » জাতীয়ভাবে সুন্দরবন দিবস পালন হোক
জাতীয়ভাবে সুন্দরবন দিবস পালন হোক
প্রকাশ ঘোষ বিধান=
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন। সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সুন্দরবন অতুলনীয় ও জীববৈচিত্র্যে অসাধারণ। এটি শুধু বাংলাদেশের মানুষের কাছে নয়, বিশ্বের প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। সুন্দরবন প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলীর অন্যতম। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখ- বনভূমি।
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন দিবস পালিত হয়ে আসছে। ভালবাসা দিবসে ভালবাসুন সুন্দরবনকে।
২০০১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের আওতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রূপান্তর ও পরশের উদ্যোগে এবং দেশের আরও ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ ঘোষণা করা হয়। ২০০১ সাল থেকে সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় জেলা গুলোতে সুন্দরবন দিবস পালন করা হলেও গত ২১ বছরেও জাতীয়ভাবে দিবসটি পালনে সাড়া মেলেনি। সে হিসেবে এবার পালিত হচ্ছে ২১তম সুন্দরবন দিবস।
সুন্দরবন দিবসের মূল অনুষ্ঠানটি হয় খুলনায়। বর্তমানে বন বিভাগ ও সুন্দরবন একাডেমির যৌথ ব্যবস্থাপনায় সুন্দরবন দিবস উদযাপনের উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠন, খুলনা প্রেসক্লাব, সুন্দরবন সংলগ্ন সাংবাদিক সমাজ এবং প্রকৃতিপ্রেমী আপামর মানুষ। তবে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় দিনটি। এরপরও সুন্দরবনের প্রতি ভালোবাসা আর মমতা সৃষ্টিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে পালিত হয় সুন্দরবন দিবস। আয়োজকরা শুরু থেকে এই দিনটিকে জাতীয়ভাবে পালনের দাবি জানিয়ে আসছেন।
সুন্দরবনের মোট আয়তন ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে এ বনের অবস্থান খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও বরগুনা জেলায় । বনটির মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। নিরীক্ষা অনুযায়ী, সুন্দরবন রয়েছে ৫ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ। বিচিত্র সব প্রাণীর বাস সুন্দরবনে। সুন্দরবনে রয়েছে প্রায় ১৯৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১২৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৭৯ প্রজাতির পাখি, ১২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩০ প্রজাতির চিংড়ি মাছ ও ৪০০ প্রজাতির মাছ। সুন্দরবনের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার পৃথিবী বিখ্যাত। এ ছাড়া রয়েছে চিত্রা ও মায়া হরিণ, বানর, বনবিড়াল, লিওপার্ড, শজারু ও বন্য শূকর। এখানে রয়েছে বিচিত্র সব পাখি। সুন্দরবনের সরীসৃপের মধ্যে রয়েছে কুমির, সাপ, গুই জাতীয় সরীসৃপ ইত্যাদি।
সুন্দরবনের অধিকাংশ গাছপালা ম্যানগ্রোভ ধরনের। এখানে রয়েছে বৃক্ষ, লতাগুল্ম, ঘাস, পরগাছা ইত্যাদি উদ্ভিদ। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত সন্ধানপ্রাপ্ত ৫০টি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের মধ্যে সুন্দরবনেই আছে ৩৫টি। সুন্দরবনের উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে সুন্দরী, গরান, গেওয়া, কেওড়া, পশুর, ধুন্দল, বাইন প্রভৃতি। এই বনের প্রায় সবখানেই জন্মে গোলপাতা।
১৮৭৮ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায় সুন্দরবন। সুন্দরবন আমাদের জাতীয় সম্পদ। এটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্য। জগদ্বিখ্যাত এ প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী হওয়াতে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়। এই বনের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতি বছর দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে আসেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস।আবার এই দিনটি সুন্দরবন দিবস। দুটি দিবসের সঙ্গে মিল হলো ভালোবাসা। সুন্দরবনের চেয়ে ভালোবাসা দিবসের গুরুত্ব বেশি পায়। সেই ভালোবাসা সিমাবদ্ধ না করে আমাদের যে বনটি রক্ষা করে চলেছে, মায়া-মমতা দিয়ে আগলে রেখেছে, জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে সেই সুন্দরবনের প্রতিও একটু ভালোবাসা থাকা প্রয়োজন। ভালোবাসা সবার জন্য।আর সুন্দরবনকে ভালোবাসা দরকার,এই সুন্দরবন বহুবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষার ফলে মানুষের মতোই সুন্দরবনকেও ভালোবাসা প্রয়োজন। সুন্দরবন বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের আঁধার। কেবল নামে সুন্দর নয়, মুগ্ধ করার মতো গঠনশৈলী আর প্রাণিসম্পদের নিদর্শন এই সুন্দরবন। করেছে। বিপরীতে প্রতিনিয়ত সুন্দরবনের গাছপালা উজাড় করে, চোরা শিকারিরা প্রাণী নিধন করে বনের স্বাভাবিক সৌন্দর্য বিনষ্ট করছে।
প্রতিনিয়ত আগ্রাসনের ফলে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন আজ হুমকির মুখে। সুন্দরবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ গোটা দেশের পরিবেশ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে আগলে রেখেছে সুন্দরবন। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো, অধিক মানুষের বসবাস ও ব্যাপক অর্থনৈতিক কাজে ব্যবহারের ফলে দিনে দিনে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে এই বন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন ছিল বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ। আর তাই হুমকির মুখে পড়া সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্য রক্ষার্থে সাধারণ জনগনের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই এই দিবসের উদ্ভব। ২০০২ সাল থেকে সুন্দরবন দিবস পালিত হলেও তা পালন করা হচ্ছে স্থানীয়ভাবে। বিশেষজ্ঞরা দিবসটিকে জাতীয়ভাবে পালনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। জাতিয়ভাবে সুন্দরন দিবস পালন এখন সময়ের দাবি। সুন্দরবন সুরক্ষায় জাতীয়ভাবে সুন্দরবন দিবস পালনের কোন বিকল্প নেই। সুন্দরবন সুরক্ষা করতে সরকার নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তাই দিবসটি জাতীয়ভাবে পালন করা হলে সুন্দরবনের গুরুত্ব বাড়ার পাশাপাশি জনগণের মধ্যে বাড়বেসচেতনতাও। তাই প্রকৃতিকে ভালোবেসে এ বন রক্ষায় সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি সরকারকেই সুন্দরবনের গুরুত্ব বুঝতে হবে। তাহলে রক্ষা পাবে সুন্দরবন।
লেখকঃ সাংবাদিক