বৃহস্পতিবার ● ১৪ জুলাই ২০২২
প্রথম পাতা » মুক্তমত » শিক্ষা বিস্তারে নিবেদিত প্রাণ প্রফুল্লচন্দ্র রায়
শিক্ষা বিস্তারে নিবেদিত প্রাণ প্রফুল্লচন্দ্র রায়
প্রকাশ ঘোষ বিধান;
বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী স্যার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনি ছিলেন একজন শিল্পাদ্যোক্তা, সমাজ সংস্কারক, বিজ্ঞানশিক্ষক, দার্শনিক, কবি, শিক্ষানুরাগী, ব্যবসায়ী ও বিপ্লবী দেশপ্রেমিক। তিনি নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে ‘আমি বৈজ্ঞানিকের দলে বৈজ্ঞানিক, ব্যবসায়ী সমাজে ব্যবসায়ী, গ্রাম্য সেবকদের সাথে গ্রাম সেবক আর অর্থনীতিবিদদের মহলে অর্থনীতিজ্ঞ।’ দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য যখন যা প্রয়োজন, সেটাই তিনি করেছেন।
তিনি ১৮৬১ইং সালের ২রা আগষ্ট বাংলাদেশের খুলনা জেলার পাইকগাছার রাড়ুলী ইউনিয়নের রাড়ুলী গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। বাবা হরিশচন্দ্র রায় ছিলেন স্থানীয় জমিদার। তাঁর মায়ের নাম ভূবনমোহিনী দেবী। বনেদি পরিবারের সন্তান প্রফুল্লচন্দ্র ছেলেবেলা থেকেই সব বিষয়ে অত্যন্ত তুখোড় এবং প্রত্যুৎপন্নমতি ছিলেন। ১৮৬৬ থেকে ১৮৭০ সাল এ চার বছর কাটে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ১৮৭১ সালে ভর্তি হন কলিকাতার হেয়ার স্কুলে। তারপর১৮৭৪ অ্যালবার্ট স্কুলে। এখান থেকেই ১৮৭৮ সালে এন্টান্স, ১৮৮১ সালে এফ,এপাশ করেন তিনি। ১৮৮২ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি এবং অনার্স সহ স্নাতকশ্রেনীতে অসাধারন মেধার বলে তিনি গিলক্রিইষ্ট বৃত্তি নিয়ে চলে যান এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকেই বি-এস-সি ডিগ্রি নেন।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সী কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর শুরু হয় তাঁর শিক্ষক, গবেষকজীবন ও বিভিন্ন সামাজিক কাজ। ঘি, সরিষার তেল ও বিভিন্ন ভেষজ উপাদান নিয়েই তিনি প্রথম গবেষণা শুরু করেন। ১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কার করেন। যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি তাঁর অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। এ ছাড়া পারদ-সংক্রান্ত ১১টি মিশ্র ধাতু আবিষ্কার করে তিনি রসায়নজগতে বিস্ময় সৃষ্টি করেন। রসায়ন শাস্ত্রেগবেষনারত প্রফুল্ল চন্দ্র মারকুইরাস নাইট্রাইট-এর মত রসায়ন শাস্ত্রে মৌলিকপদার্থ উদ্ভাবন করার মাধ্যমে চমকে দেন বিশ্বকে। এরপর থেকে সম্মান সূচকডিগ্রী ১৮৮৬ সালে পি,এইচ, ডি, ১৮৮৭ সালে ডি,এস, সি, ১৯১১ সালে সি,আই,ই, ১৯১২ সালে আবার ডি,এস,সি, পান। প্রায় ২৪ বছর তিনি এই কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন। অধ্যাপনাকালে তার প্রিয় বিষয় রসায়ন নিয়ে তিনি নিত্য নতুন অনেক গবেষণাও চালিয়ে যান। তার উদ্যোগে তার নিজস্ব গবেষণাগার থেকেই বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীকালে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তা কলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে স্থানান্তরিত করা হয়। তখন এর নতুন নাম রাখা হয় বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড।
পি সি রায়ের জীবন ছিল অনাড়ম্বর। শিক্ষাবিস্তারে তিনি ছলেন নিবেদিত প্রাণ । উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি সম্পত্তি ও তার উপার্জিত সমুদয় অর্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাত্রবৃত্তি ও জনহিতকর কাজে দান করে গেছেন। পি সি রায় শুধু নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই প্রতিষ্ঠা করেননি, সেই সময়ে প্রতিষ্ঠিত এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে পিসি রায় এর অর্থনৈতিক অনুদান ছিল না। সমবায়ের পুরোধা স্যার পিসি রায় ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে নিজ জন্মভূমিতে একটি কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী পিসি রায় পিতার নামে আর কে বি কে হরিশ্চন্দ্র স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। চারটি গ্রামের নাম মিলে ১৯০৩ সালে তিনি দক্ষিণ বাংলায় আর কে বি কে হরিশ চন্দ্র ইনষ্টিটিউট (বর্তমানে কলেজিয়েট স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পিতা ১৮৫০ ইং সনে গ্রামের বালিকাদের লেখাপড়ার জন্য তার স্ত্রী ভূবন মোহিনীর নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। নিজের রাঢ়ুলি গ্রামে পিতার প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় ভুবন মোহিনী বালিকা বিদ্যালয়ে অর্থ প্রদান করেন। বাগেরহাট পিসি কলেজ, সাতক্ষীরা চম্পাপুল স্কুল ও খুলনায পি সি রায় প্রাথমিক বিদ্যালয় অর্থানুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত তারই কীর্তি। খুলনার দৌলতপুর বিএল কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ, বরিশালে অশ্বিণী কুমার ইনষ্টিটিউশন, যাদবপুর হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল সহ প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানে তিনি আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও পি সি রায় ১৯২৬ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ১ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা দান করেন।
প্রফুল্লচন্দ্র রায় শুধু বিজ্ঞানী ছিলেন না। তিনি উচুমানের দার্শনিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক, লেখক ও সু-সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি রসায়ন পদার্থ ও জীববিজ্ঞান ছাড়াও প্রকৃতি বিজ্ঞানের উপর অসংখ্যাক প্রবন্ধ ও গ্রন্থ লিখেছেন। বাঙালিকে আত্মসচেতন করে গড়ে তোলার জন্য তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে সঙ্কট উত্তরনের পথ দেখিয়েছেন। ১৮৮৯ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষক ছিলেন। এরপর ১৯৩৬ সাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ১৯৩৭ সালে ৭৫ বছর বয়সে তিনি যখন পরিপূর্ণ অবসর নিতে চাইলেন, তখন তাকে আমৃত্যু অধ্যাপক হিসেবে রসায়নের গবেষণাকর্মের সঙ্গে যুক্ত রাখা হয়।
শিক্ষকতার জন্য তিনি সাধারণ্যে ‘‘আচার্য’’ হিসেবে আখ্যায়িত। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে তৃতীয়বারের মত তিনি ইংল্যান্ড যান এবং সেখান থেকেই সি আই ই লাভ করেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে এই ডিগ্রি দেয়। এছাড়া ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে মহীশুর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি ডক্টরেট পান। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ সরকারের থেকে নাইট উপাধি লাভ করেন । ফাদার অব নাইট্রাইট খ্যাত বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায় ১৯৪৪ সালে ১৬ জুন মৃত্যু বরণ করেন।
লেখক; সাংবাদিক