মঙ্গলবার ● ২৬ জুলাই ২০২২
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বাঘ তার প্রাকৃতিক আবাসে ভালো থাকুক
বাঘ তার প্রাকৃতিক আবাসে ভালো থাকুক
প্রকাশ ঘোষ বিধান=
২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস। সমগ্র বিশ্বে বাঘের সংরক্ষণের জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ২৯ জুলাই তারিখে পালন করা হয়। এই দিবস পালনের মুখ্য উদ্দেশ্য হল বাঘের প্রাকৃতিক আবাস রক্ষা করা এবং বাঘের সংরক্ষণের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে এর সম্পর্কে থাকা ভুল ধারণা ও ভয় দূর করা।
বাংলাদেশ, ভারত, বার্মা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল ও রাশিয়া এই ১৩টি দেশে এখন বাঘের অস্তিত্ব আছে। বাঘ বাঁচাতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বাঘ সমৃদ্ধ দেশগুলোর সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘ সমৃদ্ধ বর্ণিত ১৩টি দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে বাঘ সংরক্ষণ কার্যক্রমকে গতিশীল করার জন্য প্রতিবছর ২৯ জুলাই আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস পালন করা হয়। পুরো বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালন করা হলেও বাংলাদেশ, ভারত, নেপালসহ ১৩টি দেশে বাঘের ঘনত্ব বেশি থাকায় এসব দেশে গুরুত্ব সহকারে দিবসটি পালিত হয়।
২০১৫ সালের বাঘশুমারির প্রতিবেদন অনুসারে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। ২০১৭-১৮ বাঘশুমারিতে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৪টিতে। বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০০১-২০ সালের মধ্যে ৪৮টি বাঘ মারা গেছে। এর মধ্যে ২২টি সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগে এবং ১৬টি পশ্চিম বিভাগে মারা যায়। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আবারও বাঘশুমারি হবে।
বন বিভাগের তথ্যে জানা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৩৫০টি। এরপর ১৯৮২ সালে জরিপে ৪২৫টি এবং এর দুই বছর পর ১৯৮৪ সালে সুন্দরবন দক্ষিণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ১১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়। ১৯৯২ সালে ৩৫৯টি বাঘ থাকার তথ্য জানায় বন বিভাগ। পরের বছর ১৯৯৩ সালে সুন্দরবনের ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্যাগমার্ক পদ্ধতিতে জরিপ চালিয়ে ধন বাহাদুর তামাং ৩৬২টি বাঘ রয়েছে বলে জানায়। ১৯৯৬-৯৭ সালে বাঘের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৩৫০টি থেকে ৪০০টি। ২০০৪ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ৪৪০টি। ওই সময়ে বাঘের পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে গণনা করা হয়। একশ’ বছর আগেও পুরো বিশ্বে প্রায় এক লাখের মতো বাঘের বসবাস ছিল। সময়ের সাথে সাথে বনাঞ্চল ধ্বংস, কালোবাজারি ও চোরাকারবারীদের দৌরাত্ম্যে বাঘ হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে এই সংখ্যা হ্রাস পেতে পেতে বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৩ হাজার ৯শত বাঘের অস্তিত্ব টিকে আছে।
বাঘ বিড়াল গোত্রের বৃহত্তম বনবিড়াল। রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাংলাদেশের জাতীয় পশু। সুন্দরবনের বাঘ বিশ্বব্যাপী রয়েল বেঙ্গল টাইগার বলে পরিচিত। এ বাঘ বাংলাদেশের গর্ব। বনের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বাঘের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাঘ জীববৈচিত্র্য ও খাদ্যশৃঙ্খল প্রক্রিয়ার একটি অংশ। সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলের শীর্ষে রয়েছে বাঘ। বাঘের সংখ্যা কমে গেলে বনের পরিবেশের ভারসাম্য হারাবে। তাই বলা হয় বাঘ সুন্দরবনের পাহাদার। মধু সংগ্রহ, গোলপাতা সংগ্রহ, মাছ ধরা, বনের কাঠ ও লাকড়ি সংগ্রহ করার জন্য মানুষ অবাধে বনে প্রবেশ করছে। যার ফলে বাঘ যেমন অনিরাপদ বোধ করছে, পাশাপাশি বাঘ ও মানুষের সাথে সংঘর্ষও বাড়ছে। সে কারণে মাঝে মধ্যে বাঘের আক্রমণে মানুষের মৃত্যু হয়।
প্রাণি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা সুন্দরবনের বাঘের মৃত্যুর জন্য ৯টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়া, খাদ্য সংকট, মিঠাপানির অভাব, বন ধ্বংস, চোরাশিকারি, বাঘের আবাসস্থল অভাব, অপরিকল্পিত পর্যটন এবং বনের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচলে বনের পরিবেশ দূষণ। সুন্দরবনে বাঘের প্রজনন এবং বংশ বৃদ্ধিসহ অবাধে চলাচলের জন্য পুরো সুন্দরবনের অর্ধেকেরও বেশি এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা, টহলের ফাঁড়ি বৃদ্ধিসহ চোরা শিকারিদের তৎপরতা বন্ধে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট পেট্রোলিং চালু এবং প্রজনন মৌসুমে সকল পাশ-পারমিট বন্ধসহ বাঘ সুরক্ষায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বন বিভাগ।
বাঘ হত্যা বন্ধ করার লক্ষ্যে অধিকতর শাস্তির বিধান রেখে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ধারা-৩৬ তে বাঘ হত্যার জন্য সর্বনিম্ন ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং সর্বনিম্ন ১ লক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত করা এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড দন্ডিত করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উক্ত আইনের ধারা-৩৬ অনুযায়ী বাঘ হত্যা জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
বাঘ প্রাণিবৈচিত্রের অন্যতম একটি নিদর্শন। আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বাঘের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই বাঘ সংরক্ষণে আমাদের নানামুখী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশ্ব বাঘ দিবসকে কেন্দ্র করে বাঘ সংরক্ষণে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে হবে এবং সবাইকে সচেতন করতে হবে। বাংলাদেশে দ্রুততার সাথে দক্ষিণাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে বন ও সুন্দরবনে বাঘ রক্ষায় মনুষ্যকারণ ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার উপর নজর দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করে সময় উপযুগী ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে বাগের অস্তিত্ব সুন্দরবন থেকে বিলীন হতে পারে।
লেখকঃ সাংবাদিক