শুক্রবার ● ১৪ অক্টোবর ২০২২
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সমাজে গ্রামীণ নারীর অবদান অনস্বীকার্য
সমাজে গ্রামীণ নারীর অবদান অনস্বীকার্য
প্রকাশ ঘোষ বিধান=
১৫ অক্টোবর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস। ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ১৫ অক্টোবরকে বিশ্ব গ্রামীণ নারীদিবস পালনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরে ২০০৮ সাল থেকে এর সদস্য দেশগুলো এ দিবসটিকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে। তবে ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের চতুর্থ নারী সম্মেলনে এ দিবস পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৯৭ সালে থেকে উইমেন ওয়ার্ল্ড সামিট ফাউন্ডেশন নামক এক আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এ দিবসটি পালনের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন করে। ১৯৯৮ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। গ্রামীণ উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্রতা দূরীকরণসহ নানা ক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরুপ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে বিশ্বজুড়ে। গ্রামীণ নারীর বহুমাত্রিক ভূমিকা ও অবদানকে যথাযথ স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেয়ার জন্য আন্দোলন চলছে যুগ যুগ ধরে। তবে এর মাঝে একটু একটু করে উন্নতি করছেন অনেকেই। সমাজের অগ্রগতিতে গ্রামীণ নারীর অবদান অনস্বীকার্য।
পৃথিবীত নতুন যুগে এগিয়ে চলেছে। তবুও আজ অব্দি মানবসভ্যতার ব্যবস্থাভার পুরুষের হাতে। এই সভ্যতার রাষ্ট্রতন্ত্র অর্থনীতি সমাজ শাসনতন্ত্র গড়ে পুরুষ। নারীরা তার পিছনে থেকে কেবল করে যাচ্ছে ঘরের কাজ। গ্রামীণ নারী সারাজীবন থাকে কারারুদ্ধ। এই সব নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলার লক্ষ্যে সারাবিশ্বে প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর পালিত হয় গ্রামীণ নারী দিবস। এই দিবসের মধ্য দিয়ে মানুষকে সচেতনতার শিক্ষা দেয়া হলেও এখনো ঘরে বাইরে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে গ্রামীণ নারীরা। দেশে নারী দিবস শত বছর পার করলেও এখনো শ্রমের স্বীকৃতি মেলেনি গ্রামীণ নারীদের। ঘরে বাইরে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তারা। সংসারে তো বটেই বাইরে পরিশ্রম করে নারী বলেই তাকে হতে হচ্ছে অবমূল্যায়িত। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও ন্যায্য মজুরি বঞ্চিত হচ্ছে গ্রামীণ নারী কৃষি-শ্রমিকরা। নারী নির্যাতনের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন কোন বিষয় নয়। দেখা যায়, সমাজ-সংসার-কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গায়ই নারীকে প্রতিনিয়ত কোন না কোনভাবে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। শিশু-তরুণী-মধ্যবয়স্কা কোন নারীই নিরাপদে নেই। মানসিক-শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক নারীই বেছে নিচ্ছে মৃত্যুর পথ। মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ার ভাগ্যকে শপে দিয়ে নিরলসভাবে গ্রামীণ নারীরা স্বামী-সন্তানের সব চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছেন। শুধু পরিবার নয়, বয়ে নিয়ে চলছেন এ সমাজ ও দেশকে। কিন্তু নিজের বেলায় জুটছে চরম অবমূল্যায়ন।
দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী; আর তার শতকরা ৮৬ ভাগের বাস গ্রামে। গবেষণায় দেখা যায়, গ্রামীণ নারীরা দিনের মোট সময়ের শতকরা ৫৩ ভাগ ব্যয় করে কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্প ক্ষেত্রে। যেখানে পুরুষরা ব্যয় করে শতকরা ৪৭ ভাগ সময়। তারা পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা সব কাজে আজ অবদান রেখে চলছে। তারপরও তাদের সমাজে পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে। দেশে প্রায় দুই কোটি কর্মজীবী নারীর মাঝে দেড় কোটিই গ্রামীণ নারী। নারীরা সাধারণত সব সময় পরিবারের আয়ের দিকে ঝুঁকে থাকে। তারা সব সময় সংসারমুখী হয়ে বিভিন্ন কাজকর্মে জড়িত থাকে। বিভিন্ন কুটিরশিল্প, ছোটখাট ব্যবসা বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত হওয়ায় আগের তুলনায় কিছুটা কমে এলেও কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো তুলনামূলক বেশি। বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদন, শস্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণন পর্যন্ত প্রতি ধাপে রয়েছে নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। বাংলাদেশ যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে এতে আমাদের গ্রামীণ নারীদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু কৃষক হিসেবে না পরিবার থেকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, না সরকারিভাবে স্বীকৃতি মিলছে। কৃষি থেকে আসা আয়েও নারীদের ভাগ শুন্য। তাছাড়া ভূমিতে নেই সমঅধিকার, নেই কৃষিঋণে। দৈনিক ১২-১৬ ঘণ্টা গৃহস্থালী কাজ হোক বা কৃষি-পারিবারিক শ্রম হিসেবে গণ্য করে নারীদের এসব কাজ করতে হচ্ছে অবৈতনিক। অথচ এসব কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতামত প্রতিষ্ঠার সুযোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্য ও নির্যাতনের হার কমে আসাবে।
নারীর প্রতি সহিংসতার কারণ সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। নারীদের আজও সমাজে অবহেলার চোখে দেখা হচ্ছে।বাল্য বিয়ে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেওয়া, পড়ালেখা বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনা তো আছেই। তাদের উন্নতির কোনো চিন্তা না করে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চিন্তা করা হয়। এখনও শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন অকালে প্রাণ কেড়ে নেয় গৃহবধুর।
আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে তেমন পার্থক্য না থাকলেও উচ্চশিক্ষার বেলায় মেয়ে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে আছে বেশ, যার কারণ হিসাবে রয়েছে বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য, অভিভাবকের সদিচ্ছার অভাব এবং নিরাপত্তাহীনতা। এ লক্ষ্যে তাদের যে বিশেষ সুবিধাগুলো দরকার তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শিক্ষার সমান সুযোগ, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং সমাজের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর রয়েছে শক্তিশালী ভূমিকা। কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন নারীর অনেকেই কর্ম পরিবেশ আর সংস্থানের সুযোগ না থাকায় তাদের ভূমিকা মেলে ধরতে পারছে না। ফলে দেশও হারাচ্ছে উন্নয়নের অংশীজন। বাংলাদেশের নারীরা সমাজের সর্বস্তরে বৈষম্যের শিকার। দীর্ঘকাল নীরব উপেক্ষার পর কয়েক দশক ধরে নারীকে মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু নানা কারণে নারীর উন্নয়ন কাংখিত মাত্রায় পৌঁছেনি। তবে এ দিবসের সফলতা ক্রমশ বাড়ছে। বিভিন্ন আইন ও সচেতনতামুলক কর্মসূচির ফলে গ্রামীণ নারীদের বৈষম্যের হারও দিন দিন কমে যাচ্ছে। বাল্যবিবাহ বন্ধে প্রশাসন ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ইতোমধ্যেই নানা কর্মসূচির বাস্তবায়ন করেছে।
লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট