মঙ্গলবার ● ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বেতার বিশ্বব্যাপী একটি জনপ্রিয় গণমাধ্যম
বেতার বিশ্বব্যাপী একটি জনপ্রিয় গণমাধ্যম
প্রকাশ ঘোষ বিধান
সারাবিশ্বে বেতার এখনও অন্যতম জনপ্রিয় গণমাধ্যম। বেতারের রয়েছে পৃথিবীর দুর্গম স্থানে পৌঁছানোর শক্তি। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রসারের ফলে সম্প্রচার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিযোগিতাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। ইন্টারনেটের অগ্রযাত্রার এই সময়ে রেডিও তার গুরুত্ব হারিয়েছে ধারণাটি সঠিক নয়। কারণ সময় যেমন বদলেছে, ঠিক তেমনই সময়ের সঙ্গে তালমিলিয়ে বেতার প্রচারণার ধরণও বদলে গেছে। তাই এখনও মানুষ বেতার শোনে। অনেক মানুষ এখনও বেতারের ওপর নির্ভর করে। গ্রামগঞ্জ ও দুর্গম এলাকায় এখনও বেতার তথ্য আদান-প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম।
বেতার তার বিহিন যোগাযোগের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। এতে তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে তথ্য প্রেরণ বা গ্রহণ করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দির শেষপ্রান্তে অনেক দেশের বিজ্ঞানী প্রায় একই সময়ে বেতার আবিষ্কার করলেও গুলিয়েলমো মার্কোনিকে বেতারের আবিষ্কারক হিসাবে ধরা হয়। পূর্বে শুধু রেডিওতে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে বেতার প্রযুক্তির ব্যবহার চলছে সর্বত্র। প্রাকৃতিক উপায়ে বেতার তরঙ্গ সৃষ্টি হয় সাধারণতঃ বজ্রপাত বা মহাজাগতিক বস্তু থেকে। কৃত্রিমভাবে তৈরীকৃত বেতার তরঙ্গ মোবাইল টেলিযোগাযোগ, বেতার যোগাযোগ, সম্প্রচার, রাডার ও অন্যান্য দিকনির্দেশনা ব্যবস্থা, কৃত্রিম উপগ্রহের সাথে যোগাযোগ, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সহ অসংখ্য কাজে ব্যবহৃত হয়। টেলিভিশন,মোবাইল ফোন ইত্যাদিসহ তারবিহীন যেকোনো যোগাযোগের মূলনীতিই হল বেতার। বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে মহাকাশ পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হয় বেতার দূরবীক্ষণ যন্ত্র বা রেডিও টেলিস্কোপ।
১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী বেতার দিবস। সারা বিশ্বজুড়েই শ্রোতাদের সঙ্গে যোগাযোগের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মাধ্যম বেতার। এখনও বেতারই সর্বস্তরের কন্ঠস্বর তুলে ধরে। বেতারই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মাধ্যম। এই দিনটিতে রেডিওর গুরুত্ব তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় জরুরি যোগাযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বেতারের গুরুত্বও তুলে ধরা হয়। এভাবে যোগাযোগের এই গুরুত্বপূর্ণ ও সহজলভ্য মাধ্যমের গুরুত্ব উপলব্ধির ক্ষেত্রে এই দিবস উদযাপনের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। জনগণের কাছে তথ্য ও বিনোদন পৌঁছে দিতে বেতার বিশ্বব্যাপী একটি জনপ্রিয় গণমাধ্যম।
সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে বিশ্ব বেতার দিবস পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ বেতার, প্রাইভেট এফএম এবং কমিউনিটি রেডিও অংশগ্রহণ করছে। সারাবিশ্বে বেতার এখনও অন্যতম জনপ্রিয় গণমাধ্যম। বেতারের রয়েছে পৃথিবীর দুর্গম স্থানে পৌঁছানোর শক্তি। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রসারের ফলে সম্প্রচার জগতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। গ্রামগঞ্জ ও দুর্গম এলাকায় এষনও বেতার তথ্য আদান-প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম।
বাংলাদেশ বেতারের জন্মকালের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে এক ঐতিহাসিক মিল। বাংলাদেশে বেতারের যাত্রা শুরু ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ৩২ বছর পর এ দিনটিতেই চূড়ান্ত বিজয় লাভের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয় বাংলাদেশ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বেতার ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিহার্য সঙ্গী। বাংলাদেশ বেতার মুক্তিযুদ্ধে দেশে বীর সেনা ও স্বাধীনতাকামী মানুষের অন্যতম এক অনুপ্রেরণার মাধ্যম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বেতার কেন্দ্র। যুদ্ধের সময় এর নাম হয় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র। আর সাফল্যের পর সাফল্যের খবর শুনিয়ে সহজেই কেড়ে নেয় মুক্তিকামী মানুষের মন। মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট নামে খ্যাত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের এক বলিষ্ঠ প্রচার কান্ডারি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত কালজয়ী গান ও অনুষ্ঠানগুলো একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে শক্তিশালী করেছে, অন্যদিকে দেশের জনগণকে স্বাধীনতার দিকে অনুপ্রাণিত করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ পাকিস্তানী স্বৈরশাসকের বাঁধার মুখে ৮ মার্চে বেতারে প্রচার করা, মুক্তিকামী বাঙালিকে উদ্বুদ্ধকরণ এবং সর্বোপরি স্বাধীনতা অর্জনে বাংলাদেশ বেতার সবসময় এদেশের জনগণের পাশে থেকেছে।
২০১২ সাল থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী বেতার দিবস পালন করা হচ্ছে। দিবসটি পালিত হয় জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কোর মাধ্যমে। তবে এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে স্প্যানিশ একাডেমি অব রেডিও। তাদের অনুরোধে ইউনেস্কো ২০০৮ সালে বিশ্ব বেতার দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। প্রথম দিকে ৩০ অক্টোবর বিশ্ব বেতার দিবস হিসেবে ধার্য করা হয়। কিন্তু ২০১১ সালে ইউনেস্কো ১৩ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব বেতার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ ১৯৪৬ সালের এদিনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল জাতিসংঘ রেডিও। ২০১২ সালেই সর্বপ্রথম দুনিয়াজুড়ে দিবসটি পালিত হয়। একই বছরে আন্তর্জাতিক রেডিও কমিটিও গঠিত হয়। বিশ্ব রেডিও দিবসের মূল অনুষ্ঠান পালন করা হয় ইউনেস্কোর সদর দপ্তর প্যারিসে। প্রথম থেকে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। তার ব্যতীত যোগাযোগের এই শক্তিশালী মাধ্যমটি প্রথম ব্যবহার শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে। আবিস্কারক হিসেবে ইতালির মার্কনিকে (১৮৯৮) ধরা হলেও বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু তারও চার বছর আগে (১৮৯৪) বেতারে শব্দ প্রচারে সফল হন। বাংলাদেশ বেতারের যাত্রা শুরু হয় ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ঢাকায় একটি মিডিয়াম ওয়েভ স্টেশন চালু করে। ঢাকার নাজিম উদ্দীন রোডের দোতলা বাড়িতে (বর্তমানে বোরহান উদ্দিন কলেজ ভবন) অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র চালু হয়। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান ব্রডকাস্টিং ঢাকা নামে এবং পরে ১৯৪৮ সালে রেডিও পাকিস্তান নামে তা পরিচিত হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর এর নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ বেতার।
দেশে ২২টি বেসরকারি এফএম এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও চলছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ বেতার ১২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং ৩৫টি এফএম রেডিও পরিচালনা করছে। কমিউনিটি রেডিওগুলোর মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় এই গণমাধ্যম পৌঁছে গেছে। এর মাধ্যমে দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিজেদের কথা সরাসরি বলার সুযোগ পেয়েছেন। বেতার তথ্য আদান-প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম। দুর্যোগের এই সময়ে সঠিক বার্তা, দিকনির্দেশনা, মহামারি থেকে সুরক্ষা পেতে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে বেতার আস্থার জায়গা অর্জন করেছে।
লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট