শনিবার ● ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » জীবনের শৃঙ্খলাবোধ গড়তে স্কাউটিং যথেষ্ট সহায়ক
জীবনের শৃঙ্খলাবোধ গড়তে স্কাউটিং যথেষ্ট সহায়ক
প্রকাশ ঘোষ বিধান
সেবার মূলমন্ত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে স্কাউট আন্দোলন। মানবজীবনের একমাত্র ব্রত হল সেবা। মানবহৃদয়ের সব তৃপ্তি, সুখ ও সাফল্য সেবার মধ্যেই নিহিত। শৃঙ্খলা হলো মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শৃঙ্খলার নানা বন্ধনে মানুষ অর্জন করেছে শ্রেষ্ঠত্ব, নির্মাণ করেছে সভ্যতা। আত্মনির্ভরশীল সু-নাগরিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে স্কাউট আন্দোলন বিশ্বব্যাপি সমাদৃত।
২২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্কাউট দিবস। জীবনের শৃঙ্খলাবোধ ফিরিয়ে আনতে স্কাউটিং যথেষ্ট সহায়ক। স্কাউটিংয়ের মাধ্যমে একজন ছেলে অথবা মেয়ে নিজেকে একজন প্রকৃত অর্থে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম। স্কাউট শব্দের অর্থ চর, গুপ্তচর। আবার স্কাউট শব্দটি দ্বারা সাধারণত উদার, ভাগ্যবান, আনন্দদায়ক বোঝানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ এই সংস্থাটি আনন্দের মধ্য দিয়ে শিক্ষাদান করে থাকে। স্কাউটিং এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে শিশু, কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সামাজিক গুণাবলী উন্নয়নের মাধ্যমে তাদেরকে পরিবার, সমাজ, দেশ তথা বিশ্বের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।
বিশ্ব স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ব্যাডেন পাওয়েল এর জন্মদিন ২২ ফেব্রুয়ারি। তিনি ১৮৫৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পুরো নাম রবার্ট ষ্টিফেনশন স্মিথ লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল অব গিলওয়েল। ব্যাডেন পাওয়েল বা বিপি নামে তিনি সর্বোধিক পরিচিত। তারই হাত ধরে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে স্কাউটিং আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তাই প্রতি বছর ২২ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী স্কাউট দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৬৯টি সদস্য দেশসহ বিশ্বব্যাপী দুইশ ১৬টি দেশ ও অঞ্চলে ওয়ার্ল্ড অরগানাইজেশান ওব দ্য স্কাউট মুভমেন্ট (ডাব্লিউওএসএম) দিনটিকে স্কাউট ফাউন্ডার্স ডে হিসেবে উদ্যাপন করছে।
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে স্কাউটিং আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে স্কাউটিংয়ের যাত্রা শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে। আর ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ইস্ট পাকিস্তান বয়স্কাউট অ্যাসোসিয়েশনের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭২ সালে তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ বয়স্কাউট অ্যাসোসিয়েশন। ১৯৭৮ সালে আবার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ স্কাউটস। সংগঠনটিতে নারীদের সদস্য হওয়ার নিয়ম ছিল না। ১৯৯৪ সালে স্কাউট নারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ১৯৯৪ সাল থেকে মেয়েরা এর সদস্য হওয়ার অধিকার লাভ করে। বাংলাদেশ স্কাউটস সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ১০ লাখ ১৫ হাজার ১১৬ জন স্কাউট রয়েছেন। আমাদের দেশে এর কার্যক্রম ব্যাপক পরিসরে চলমান।
ব্যাডেন পাওয়েল বা বিপি ১৯০৭ সালে ২০ জন ছেলেকে নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ব্রাউন্সী দ্বীপে স্কাউট ক্যাম্প শুরু করেন। বর্তমানে পৃথিবীর ১৬৯ টি দেশে স্কাউটিং আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে। পৃথিবীতে প্রায় ৫ কোটি স্কাউট সদস্য রয়েছে। বাংলাদেশ প্রায় ১৭ লক্ষ স্কাউট সদস্য নিয়ে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম স্কাউট রাষ্ট।
১৮৫৭সালের ২২ ফেব্রুয়ারি লন্ডনের হাইড পার্কের পাশে একটি বাড়িতে পাওয়েল জন্ম গ্রহন করেন। বাবা ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, রেভারে- এইচজি ব্যাডেন পাওয়েল আর মা ছিলেন বৃটিশ এডমিরাল ডাব্লিউটি স্মিথের কন্যা হেনরিটা গ্রেসা। রবার্ট ব্যাডেন পাওয়েল ১৮৭৬ সালে একজন লেফটেন্যান্ট হিসেবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সামরিক বাহিনীতে কর্মরত থাকাকালীন বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে তিনি স্কাউট আন্দোলন গড়ে তোলার প্রেরণা পান। বিশেষ করে ম্যাফেকিং-এর যুদ্ধে তিনি বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ধারণা থেকে উপলব্দি করেন যে, যুবক ও বালকদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করানো সম্ভব। এ যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক বালকদলের অবদান দেখে অভিভূত হন। তখন থেকেই তিনি বালকদেরকে নিয়ে কিছু একটা করার পরিকল্পনা করতে স্বপ্ন ও শ্রমকে অব্যহত রাখেন। যা পরবর্তীতে স্কাউট আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ । তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ল্যাফটেনেণ্ট জেনারেল ছিলেন। রবার্ট ব্যাডেন পাওয়েল ১৯৪১ সালের ৮ জানুয়ারি কেনিয়ার নাইরোবিতে মৃত্যুবরণ করেন।
স্কাউটিং এমন একটি আন্তর্জাতিক, শিক্ষামূলক ও অরাজনৈতিক আন্দোলন, যার মাধ্যমে শিশু, কিশোর ও যুবকদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, বুদ্ধিভিত্তিক ও আধ্যাত্মিকভাবে যোগ্য করে গড়ে তোলা হয়। স্কাউটিং বিশ্বের একমাত্র সংগঠন, যেখানে যোগদান করতে হলে আত্মশুদ্ধি পালন করতে হয়। আগ্রহীদের অতীত জীবনের সব বদঅভ্যাস পরিত্যাগ করার শপথ নিতে হয়। মদ, জুয়া, যৌনতা, শঠতা ও নাস্তিকতা থেকে জীবনকে রক্ষা করতে হয়। স্কাউট-প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হয়।
বর্তমানে পৃথিবীর ১০০ কোটি স্কাউট ও গার্লস গাইড বিভিন্ন স্কাউটিং সমিতির প্রতিনিধিত্ব করছে। স্কাউটিং, স্কাউট আন্দোলন নামেও পরিচিত, একটি বিশ্বব্যাপী যুব আন্দোলন যা স্কাউট পদ্ধতিতে নিযুক্ত করে, ক্যাম্পিং, কাঠের কারুকাজ, জলজ, হাইকিং, ব্যাকপ্যাকিং এবং খেলাধুলা সহ ব্যবহারিক বহিরঙ্গন কার্যকলাপের উপর জোর দিয়ে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার একটি প্রোগ্রাম।
স্কাউটিং কমিউনিটি সেবা, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিশুকল্যাণ, নির্মাণ ও বাড়িঘর তৈরিতে তারা সহায়তা করে থাকেন। এ ছাড়া বন্যা, ঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামাল দিতে, অসহায় মানুষের আশ্রয় বা পুনর্বাসনে তারা স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে টিকাদান, ত্রাণ পৌঁছানো, পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্কাউট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সদা প্রস্তুত স্কাউট সদস্যদের নানাবিধ কার্যক্রমের গুরুত্ব দেশে ও জাতি গঠনে অপরিসীম ভূমিকা। বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও মূল্যবোধ অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে দেশ ও জাতি গঠনে স্কাউট আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিহার্য।
লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট।