বুধবার ● ১ মার্চ ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » বন্যপ্রাণী জীববৈচিত্র্যের প্রাণ
বন্যপ্রাণী জীববৈচিত্র্যের প্রাণ
প্রকাশ ঘোষ বিধান ;
কৃষিজমির বিস্তার ও নগরায়নের কারণে দেশে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। এ কারণে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে অনেক বন্যপ্রাণী। বনভূমি কমে যাওয়ায় দেশের সমগ্র জীববৈচিত্র্য সার্বিকভাবে সংকটের মুখে পড়েছে। মানুষের খাদ্য, বস্ত্র ও ওষুধ- এই প্রধান তিনটি প্রয়োজনীয় উপাদান জীববৈচিত্র্য থেকে আসে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, বনভূমি ধ্বংস, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যই হুমকির সম্মুখীন। তাই বিশ্ব জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা একান্ত দরকার। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার রোধের গুরুত্ব এবং বন্যপ্রাণী সম্পর্কে নিজেদের সচেতন করা। আমাদের প্রয়োজনে বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে।
বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস। ২০১৪ সালে প্রথম এ দিবসটি পালন করা হয়। জাতিসংঘভূক্ত দেশগুলো এ দিবসটি পালন করে থাকে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনে ৩ মার্চকে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিশ্বের বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদকূলের প্রতি গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা এই দিবসের মূল লক্ষ্য। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত বিবরণীতে, বন্যপ্রাণীদের অপরিহার্য মূল্য এবং বিভিন্ন অবদানের কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এতে পরিবেশগত, জিনতাত্ত্বিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাবিষয়ক, সাংস্কৃতিক, বিনোদনমূলক এবং নান্দনিক বিষয়ের সাথে যুগসই উন্নয়ন এবং মানবকল্যাণের দিকে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বিশ্বের বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদকূলের প্রতি গণসচেতনতা গড়ে তোলা, এবং সিআইটিইএস-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকার করা বলা হয় আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য যাতে বন্য প্রজাতিদের টিকে থাকতে হুমকি হয়ে না দাঁড়ায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড এক প্রতিবেদনে জানায়, ১৯৭০ সাল থেকে বিশ্বে এ পর্যন্ত বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমেছে দুই- তৃতীয়াংশ। এভাবে বাংলাদেশের ভূখন্ড থেকে হারিয়ে গেছে ৩১ প্রজাতির প্রাণী। এছাড়াও বাংলাদেশে অন্তত ২১৯টি প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিপন্ন। এই তালিকার মধ্যে আছে উভচরসরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী। বনবিভাগের এক হিসাবে ৪২ প্রজাতির উভচরের মধ্যে ৮টি, ১৫৮ টি প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে ৬৩টি, ৭৩৬টি প্রজাতির পাখির মধ্যে ৪৭টি, ১২৪টি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে ৪৩টির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন।
জীববৈচিত্র্য মানে প্রাণের বৈচিত্র্য। জীববৈচিত্র্য বলতে সাধারণত উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যা, প্রজাতিভেদ এবং বৈসাদৃশ্যকে বুঝানো হয়ে থাকে। এক প্রাণগোষ্ঠী জীবনের তাগিদে অন্য কোন প্রাণগোষ্টীর উপর নির্ভরশীল। মানুষের খাদ্য, বস্ত্র ও ঔষধ এই প্রধান তিনটি প্রয়োজনীয় উপাদান জীববৈচিত্র্য থেকে আসে। মানুষের জীবনে যত উপকরণ ও উপাদান প্রয়োজন, তার সবই পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের মধ্যে নিহিত রয়েছে।
বিশ্ব জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোর মধ্যে পৃথিবীর ৫৬০তম ও বাংলাদেশের প্রথম রামসার সাইট সুন্দরবন, বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট হাকালুকি হাওড়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল, লাউয়াছড়া উদ্যান, শালবন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তবে উদ্বেগের বিষয় বাংলাদেশে বনভূমি ধ্বংস করছে কৃষিজমির বিস্তার ও নগরায়ন। এ কারণে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে অনেক বন্যপ্রাণী। বনভূমি কমে যাওয়ায় দেশের সমগ্র জীববৈচিত্র্য সার্বিকভাবে সংকটের মুখে পড়েছে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভবন নয়নাভিরাম সুন্দরবনের মোট আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এর মধ্যে বাংলাদেশে সুন্দরবনের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বনভূমি চার হাজার ৮৩২ এবং জলাভূমি এক হাজার ১৮৫ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনের ৪৫০টি ছোট-বড় নদী ও খাল রয়েছে। এই বনভূমি ও জলাভূমিতে বাস করে ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ ও ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী। সারাদেশে মেরুদন্ডী ও অমেরুদন্ডী প্রাণির আনুমানিক মোট প্রজাতি ১১হাজার ৮শত এর মধ্যে সুন্দরবনে রয়েছে ২ হাজার ২শত। সারাদেশে চিহ্নিত প্রজাতির সংখ্যা ৭ হাজার ৯৭০। ২০১৮ সালে করা সর্বশেষ শুমারিতে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪। সুন্দরবনের অনেক বন্যপ্রাণীই এখন ভালো নেই। বাঘ শিকার কমলেও থেমে নেই হরিণ শিকার। ইতোপূর্বে বন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে গন্ডার, বনমহিষ, মিঠা পানির কুমির, এক প্রজাতির হরিণ, চিতা বাঘ ও চার প্রজাতির পাখি। জেলেদের জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে ডলফিন, শুশুক, কুমিরের বাচ্চা ও বিরল প্রজাতির কচ্ছপ। জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মানুষের নানা অত্যাচারে কয়েক প্রজাতির প্রাণী এখন সংকটাপন্ন। বনের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরার ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে মাছ ও কাঁকড়ার ওপর। বিলপ্ত হতে চলেছে ১৯ প্রকার মাছ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের স্থলভাগে যত মূল্যবান ও সুন্দর বস্তু রয়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অথৈ জলরাশি ও বনের গভীরে লুকিয়ে রয়েছে। প্রাণের প্রথম বিকাশ ঘটেছিল সমুদ্রে। তাই স্থলের চেয়ে জলেই আছে সবচেয়ে বেশি প্রাণী । ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জলজ, খনিজসম্পদ, প্রাণীকূল ও মহামূল্যবান উদ্ভিদের স্বর্গরাজ্য বঙ্গোপসাগর এবং সুন্দরবন। বহু বছর ধরে আমাদের বাংলাদেশের সমুদ্র ও সুন্দরবনসহ বনগুলো ঐশ্বর্য লালন করছে। তবে আমাদের ভুলের মাশুল সমুদ্রের ঐশ্বর্যের ওপর প্রভাব পড়ছে। মাছ শিকারের টুকরো উপাদান, কার্গো জাহাজগুলোর বাতিল অংশ, প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগ, জাহাজের বর্জ্য ও তেল সমুদ্রকে দূষিত করছে। এর প্রভাবে জীববৈচিত্রের ওপর পড়ছে। তার প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছে মানবসভ্যতা। এছাড়া কল-কারখানার বর্জ্যসহ নানা কারণে ভারসাম্যহীনতার দিকে যাচ্ছে সামুদ্রিক প্রতিবেশ।
প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী। মানুষ ও বৈরী প্রকৃতি, বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস, খাদ্যাভাব এবং অবৈধ শিকারের কারণে দিন দিন বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া তালিকায় দীর্ঘ হচ্ছে বিপন্ন বন্যপ্রাণীর নাম। এরইমধ্যে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ১৩ প্রজাতির মেরুদন্ডী প্রাণী। আর সুন্দরবনে প্রাণী শিকার, বনউজাড় জলবায়ুর ওপর প্রভাব ফেলছে। তাই প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে মহাসাগর, সুন্দরবনসহ সব প্রজাতির বন্যপ্রাণীকে সুরক্ষিত ও রক্ষা করতে জনসাধারণ ও নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকার বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে নানাভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছে। এমনকি সংবিধান এর-১৮(ক) অনুচ্ছেদে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’
তথাপি সংশ্লিষ্ট সেক্টরগুলোর আন্তযোগাযোগ ও সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে নানাভাবে বনের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে এবং হচ্ছে। শুধু বিপন্ন বন্যপ্রাণী রক্ষা করে প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার হবে না বেদখল বনভূমিও উদ্ধার করতে হবে। বন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সংরক্ষিত বন জবরদখল হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ একর, আর আইনি পদক্ষেপসহ উদ্ধারের জন্য উদ্যোগ রয়েছে মাত্র ১২ হাজার ২১৪ একর বনভূমির।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকার বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ পাস করেছে। এ আইনে পাখি শিকার, হত্যা, আটক ও কেনা বেচা দন্ডনীয় অপরাধ। ১৯৭৪ সালে বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন ও ২০১২ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে দন্ডের বিধান রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছর জেল, এক লাখ টাকা দন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত। একই অপরাধ ফের করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণের বিধানও রয়েছে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার ৫১টি এলাকাকে রক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কার্যক্রমকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন’ প্রবর্তন করেছে। বন্যপ্রাণী অপরাধ উদঘাটনে তথ্য (প্রদানকারী) পুরস্কার বিধিমালা, ২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী পাচাররোধে এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অপরাধ দমন ইউনিট কাজ করছে। মহাবিপন্ন বাংলা শকুন রক্ষায় ২০১৪ সালে দেশের দু’টি অঞ্চলকে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। শকুনের জন্য ক্ষতিকারক ভেটেরিনারি ওষুধ ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রফেনের উৎপাদন দেশব্যাপী নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণের জন্য ৬টি এলাকাকে ইস্ট এশিয়ান অস্ট্রালেশিয়ান ফ্লাইওয়ে সাইটঘোষণা করা হয়েছে। ডলফিন, তিমি, হাঙ্গর এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণের জন্য বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এলাকার ১৭৩৮ বর্গ কিলোমিটার এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১৭৪৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে মেরিন প্রটেকটেড এরিয়া হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। হাতি সংরক্ষণের জন্য চট্টগ্রামের চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যকে মাইক সাইট ঘোষণা করা হয়েছে।
পৃথিবীকে যান্ত্রিক আধুনিকতার ছোঁয়া যত স্পর্শ করছে, মানুষের মনের চাহিদা ততোধিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ তার নিজের স্বার্থে বনজ সম্পদ ধ্বংস করছে। আর এর ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণীরা। তারা শুধু নিজেদের বাসস্থানই হারাচ্ছে তা নয়, এর সঙ্গে তারা চরম খাদ্য সংকটে মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে প্রবেশ করে এ সমস্ত বন্যপ্রাণীরা মানুষের হাতে প্রাণ হারাচ্ছে। তাছাড়া কিছু অসাধু ব্যক্তি বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে বন্যপ্রাণী ও পাখি শিকার করছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বনভূমির সংখ্যা কমতে থাকায় বন্যপ্রাণীরা অজান্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, বনের বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণেও বন্যপ্রাণীরা বিলুপ্তির পথে। তাই এই বিশ্বকে বাঁচিয়ে রাখতে মানুষের পাশাপাশি বন্যপ্রাণীদের সমানভাবে মর্যাদা দিতে এবং তাদের সংরক্ষণ করার জন্য দিনটি পালন করা অত্যন্ত জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট