বৃহস্পতিবার ● ৬ এপ্রিল ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » জামাই ; কে কার জামাই
জামাই ; কে কার জামাই
প্রকাশ ঘোষ বিধান =
জামাই একটি সম্পর্কের নাম। বড় আদরের সম্পর্ক। কে জামাই, কে কার জামাই, কে বা কারা জামাই বলে কাকে ডাকবে। ইদানীং অনেক মেয়েই জামাই শব্দের অর্থ না জেনে ভুল ব্যবহার করছে। নিজের স্বামীকে তারা জামাই বলছে। এ জামাই শব্দে স্বামী স্ত্রী শ্বশুর শাশুড়ীর মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন। আরও বড় প্যাচে পড়েছে এই জামাই কথার সম্পর্ক গণমাধ্যম প্রচারে। বিশেষ করে টেলিভিশনের নাটক বা ছবিতে স্ত্রী তার নিজের স্বামীকে জামাই বলে ডাকতে দেখা যায়। এতে বেশীর ভাগ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে এই জামাই শব্দের ব্যবহারে। নাট্যকার যিনি নাটক লিখেছেন তিনি কি কখন এ বিষয় ভেবেছেন। নাকি তিনি নাটকের জন্য আঞ্চলিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে স্ত্রীর স্বামীকে জামাই বলা শব্দটি ব্যবহার করছেন। এতে জামাইয়ের প্যাচ না ছাড়িয়ে আরও জামাই প্যাচে স্বামী স্ত্রী ও শ্বশুর শাশুড়ীর মধ্যে পেচিয়ে যাচ্ছে। জামাই শব্দটির ব্যবহার এখন জগাখিচুড়ি অবস্থায় পড়েছে।
বাংলা একাডেমির সমার্থক শব্দ কোষ অনুযায়ী স্বামী শব্দের বিকল্প বর, পতি, দয়িত, কান্ত, নাথ ইত্যাদি শব্দ দেখা যায়। জামাই কথার সংস্কৃত শব্দ জামাতা। সংস্কৃতে জামাতা আর ফারসিতে দামাদ। এই দুই শব্দেরই অর্থ মেয়ের স্বামী। জামাই শব্দের ইংরেজি সন ইন ল। সন ইন ল বা আইনগত পুত্র যা মেয়ের স্বামী। জামাই-এর অর্থ মেয়ের স্বামী। বাংলায় জামাই শব্দটিও মেয়ের স্বামী অর্থে ব্যবহার হওয়ার কথা। তবে আমাদের সমাজে কোনও কোনও অঞ্চলে নিজের স্বামী বোঝাতে জামাই শব্দের ব্যবহার হয়ে আসছে। যেটি সম্পর্কের ভূল ব্যবহার করা হচ্ছে।
জামাই কথাটার মূল সংস্কৃত জামাতা শব্দ। জামাই শব্দের অর্থ মেয়ের স্বামী। জামাই শব্দটা মূলতঃ শ্বশুর শাশুড়ীর জন্য, তারা তাদের মেয়ের স্বামীকে বলবে আমার জামাই। অথচ আজকাল অনেক মেয়েই না জেনে শব্দটাকে বিকৃত করে ফেলছে। আপনি যদি বলেন যে আমার জামাই, তার মানে সে আপনার মেয়ের স্বামী, আপনার স্বামী নয়। স্বামী, বর, পতি, হাজব্যান্ড এমন নানা প্রতিশব্দ ব্যবহার করতে পারেন চাইলে। আপনার মা এবং আপনি দুজনই যদি আপনার স্বামীকে জামাই বলেন। তবে জামাই বলে আপনার মা ঠিকই বলছেন। আর আপনি নিজের স্বামীকে জামাই বলে সম্পর্কের অপপ্রয়োগ করছেন।
মেয়ের হাসবেন্ড কে জামাই বলবে শ্বশুর শাশুড়ী, শ্বশুর হলো স্বামী বা স্ত্রীর পিতা। শাশুড়ি হলো স্বামী বা স্ত্রীর মাতা বা তৎস্থানীয়া নারী। জামাই হলো কন্যার স্বামী, জামাতা। নাতজামাই হলো নাতনির স্বামী। ঠাকুর জামাই ননদের বর বা ননদাই।
আঞ্চলিকতা ও নানা ক্ষেত্রে জামাইয়ের অর্থ নানা রকম ব্যবহার করা হয় । শুধুমাত্র জামাই না সকল শব্দের ক্ষেত্রেই আছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কোন শব্দ ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়। যেমন সিলেটে, মেয়ে তার হাজব্যান্ড কে জামাই আর শাশুড়ী তার মেয়ের হাজব্যান্ড কে দামান্দ বলে। খুননাঞ্চলের কিছু কিছু লোক ফুফুর হাসবেন্ডকে ভাইপোরা জামাই বলে। ঘর জামাই, কে ঘর জামাই। যে পরিবার ব্যবস্থায় স্বামী তার স্ত্রীর গৃহে বসবাস করে আঞ্চলিক ভাষায় তাকে ঘর জামাই বলা হয়। জামাইবরণ, উৎসব বা বিবাহ উপলক্ষ্যে কন্যাগৃহে সমাগত পাত্রকে কন্যাপক্ষীয় স্ত্রীলোকদের দ্বারা বরণের অনুষ্ঠান। জামাই আদর, শ্বশুরালয়ে জামাই যেমন আদরযত্ন পায় সেই রকম যত্ন পরম সমাদর। জামাইষষ্ঠী, জ্যৈষ্ঠ মাসের শুল্কষষ্ঠীতে হিন্দুদের জামাইবরণের অনুষ্ঠান। জামাইদের উদ্দেশ্যে যে মেলার আয়োজন করা হয়। জামাইদের নিয়ে এমন নানা অনুষ্ঠান রয়েছে।
হিন্দু সমাজের একটি পর্ব জামাই ষষ্ঠী। জামাই ষষ্ঠী মানেই বাঙালিদের কাছে একটি উৎসব। বহু জামাই আছেন এমন দিনে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে হাতে মিষ্টির ঝোলা ও বিশাল মাছ হাতে শ্বশুরবাড়িতে হাজির হতে পছন্দ করেন। জামাই হল গিয়ে মেয়ের বর। মেয়েকে ছেড়ে জামাই আদরের এত ঘটা করে আপ্যায়ণ করা এদিনে। শাশুড়ি তার জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় এই ব্রত করেন।
নতুন পাত্রে আমের পল্লব এবং আম ও তৎসহযোগে পাঁচ ধরনের ফল সাজিয়ে জামাই-এর মনঙ্গল কামনায় শাশুড়ির দল জামাই ষষ্ঠীর দিনে এ ব্রত পালন করেন। জামাই-এর মঙ্গলার্থে ধান-এর ব্যবহার। কারণ, ধান সমৃদ্ধির ও বহু সন্তানের প্রতীক। দুর্বা ব্যবহৃত হয় চির সবুজ ও সতেজের প্রতীক হিসাবে। এর মানে জামাই-এর দীর্ঘায়ু কামনা। এখানেই শেষ নয় জামাই-কে আশীর্বাদ করে ষাট-ষাট বলাটাও শাশুড়িদের নিয়মের মধ্যে পড়ে। মনে রাখবেন এর সমস্তটাই হচ্ছে শুধু জামাই-এর জন্য। আসলে মেয়ের জন্য মঙ্গলচিন্তা এবং তাঁর সংসার অঁটুট রাখার প্রার্থনাতেই এত আয়োজন হয়। আসল কথা মেয়ে যাতে সুখে শান্তিুতে দাম্পত্য জীবন কাটাতে পারে তাই জৈষ্ঠ মাসে জামাইকে আদর করে বাড়িতে এনে আমা-দুধ খাইয়ে আশীর্বাদ হিসাবে দামি উপহার দেওয়া হয়।
জামাই শব্দটি একটি সম্পর্কের নাম। জাতিয় পর্যায় সার্বজনিন ভাবে এর সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন। মিডিয়া বা গণমাধ্যম বহুল প্রচারিত। বিশেষ করে টেলিভিশন বা গণমাধ্যমে জামাই শব্দটির যথাযত প্রচার হওয়া দরকার। তা নাহলে আঞ্চলিক অর্থে ব্যবহৃত একটি শব্দ জাতীয় ভাবে প্রচারে নানা বিভ্রান্তি সৃস্টি করতে পারে।
লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট