রবিবার ● ৩০ এপ্রিল ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » মে দিবসের ইতিহাস ও তাৎপর্য
মে দিবসের ইতিহাস ও তাৎপর্য
প্রকাশ ঘোষ বিধান:
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস যা মে দিবস নামে অভিহিত। প্রতি বছর পয়লা মে তারিখে বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয় দিবসটি। আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের উদযাপন দিবসটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে পালন করে। বাংলাদেশে শ্রমজীবি মানুষের সংখ্যা অনেক। মে দিবসের সম্মানার্থে বাংলাদেশেও ১ মে সরকারী ছুটির দিন। এদিন শ্রমিকরা মহা উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পালন করে মে দিবস। তারা তাদের পূর্বসূরীদের স্মরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে । শ্রমিক সংগঠনগুলো মে দিবসে আয়োজন করে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ও কল্যাণমুখী কর্মসূচির। বাংলাদেশের শ্রমিকরা এদিন আনন্দঘন পরিবেশে উদ্যাপন করে মহান মে দিবস।
মে দিবস একদিনে আন্তর্জাতিক রুপ পায়নি। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। ছিল নানা ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে, জুলুম, অত্যাচারে, ধর্মঘটে, মিছিলে, সংগ্রামের রক্তঝরার কাহিনি। আন্দোলনের পথ কখনই মসৃণ ছিল না। জন্মলগ্ন থেকেই শ্রমিকশ্রেণীর ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস।
মে দিবসের মূল প্রতিপাদ্য শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া আদায়। আর এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল দেড়শ বছর আগে অস্ট্রেলিয়াতে। শ্রমিকশ্রেণীকে কাজ করতে হতো আঠারারো ঘণ্টা, কুড়ি ঘণ্টা পর্যন্ত। ১৮০৬ সালে কারখানায় কুড়ি ঘণ্টা পর্যন্ত কর্মপ্রহর ছিল বাধ্যতামূলক। কল-কারখানা তখন গিলে খাচ্ছিল শ্রমিকের গোটা জীবন। অসহনীয় পরিবেশে প্রতিদিন কাজ করতে হতো। সপ্তাহজুড়ে কাজ করে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে যাচ্ছিল। শ্রমজীবি শিশুরা হয়ে পড়েছিল কঙ্কালসার। ১৮৬২-১৮৬৩ সালে গড়ে ওঠে ট্রেড ইউনিয়ন দাসপ্রথাও বিলুপ্ত হয়। এই সময়ে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এসুযোগে মালিকরা কম মজুরিতে নারী শ্রমিক নিয়োগ করত। ১৮৬৫ সালে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের পর থেকেই সেখানকার শিল্পের বিকাশ ঘটে দ্রুত গতিতে। সেই সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের প্রসারও ঘটে দ্রুত।
১৮৮১ সালে নভেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় আমেরিকান ফেডারেশ অব লেবার। ১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর সেখানে চতুর্থ সম্মেলনে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাতে বলা হয় ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে সব শ্রমজীবী মানুষ আট ঘণ্টার বেশি কোনওভাবেই কাজ করবে না। ওই দিনটিতে তিন লক্ষ শ্রমিক প্রত্যক্ষভাবে ধর্মঘটে যোগ দেন। শাসকদল ঐক্যবদ্ধ এই বিশাল শ্রমিক সমাবেশ ও ধর্মঘট দেখে ভয়ে পিছিয়ে যায়।
আট ঘণ্টা শ্রম দিবস- এই দাবিকে কেন্দ্র করেই আন্দোলনের সূত্রপাত। ১৮৮৬ সালের ১মে’তে সারা আমেরিকায় শ্রমিক ধর্মঘটের ডাক দেয়। ওই দিনই শিকাগোতে হাজার হাজার শ্রমিক র্যালীতে যোগ দেয়। শ্রমিক র্যালীর স্লোগান ছিল, আট ঘন্টার শ্রম, আট ঘণ্টার ঘুম, এবং আট ঘণ্টার বিনোদন। ৩ মে ছিল আন্দোলনের দিক নির্ধারিত করার দিন। এদিন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কারখানার মালিকদের ভাড়াটে লোকদের সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে চারজন শ্রমিক মারা যান। এরই প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ শ্রমিক নেতারা ৪ মে জোরালো আন্দোলনের ডাক দেয়। এই দিন তিন হাজারের মতো শ্রমিক শিকাগোর হে মার্কেট স্কোয়ারে আন্দোলনে যোগ দেন। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বিকেলে শেষের দিকে পুলিশ শ্রমিকদের উপর গুলি চালায়। এতে অনেক শ্রমিক নিহত হয়। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন দাঙ্গায় রূপ নেয়। এই সময় পুলিশ আটজন নেতাকে গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযাগে। আনা হয় হত্যা, দাঙ্গা সৃষ্টি করার। শুরু হয় ঐতিহাসিক বিচারকার্য। নেতাদের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ উত্থাপন করতে না পারলেও বিচারক এদের সবাইকে প্রাণদ-ের আদেশ দেন। ১৮৮৭ সালে ১১ নভেম্বর অগাস্ট পাইস, এ্যালবার্ট পারসন, এ্যাডলফ ফিশার ও জর্জ এনগেলকে প্রাণদ- দেয়া হয়। লুইস লিংগ বন্দি অবস্থাতেই আত্মহত্যা করেন। প্রতিবাদের ঝড় উঠল। এরপর এই আন্দোলন শুধু আমেরিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৮৯ সালের জুলাই মাসে ফ্রান্সের প্যারিসে আয়োজন করা হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক কংগ্রেসের। এখানেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন করা হবে। প্রতিবছর শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংহতি ও সংগ্রামের দিন বলে ঘোষিত হল ১ মে। এভাবেই ১৮৮৬ সালের ঐতিহাসিক মে দিবস রপান্তরিত হয় ১৮৯০ সালের আন্তর্জাতিক মে দিবসে। সারা বিশ্বের মেহনতী মানুষের শ্রমের ক্ষেত্রে ন্যায্য মজুরি ও দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো নগরীতে আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আজ বিশেষভাবে স্মরণীয়। চাকরিরত যে-কোন দেশের যেকোন মানুষ সেই আন্দোলনের সুফল ভাগ করছেন। দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের ব্যবস্থাপনা এখন প্রায় সবদেশেই প্রতিষ্ঠিত। মে দিবস তাই দুনিয়ার মেহনতি মানুষের সঙ্কল্প গ্রহণের দিন। এই সঙ্কল্প হল সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শ্রেণীবৈষম্যের বিলোপসাধন। পুঁজিবাদী দাসত্বশৃঙ্খল থেকে মুক্তির দৃঢ় অঙ্গীকার। মে দিবস শ্রমিকশ্রেণীর চিন্তা-চেতনায় এনেছে এক বৈপ্লবিক তাৎপর্য।
মে দিবস দুনিয়া জুড়ে শ্রমিক আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চক্রান্তের তীব্র প্রতিবাদ, দুনিয়ার শ্রমিক এক হওয়ার উজ্জীবন মন্ত্র। মে দিবসের এই দীর্ঘ চলার পথে অনেক অন্ধকার দূর হয়েছে। সংগ্রামী শ্রেণির সামনে উন্মোচিত হয়েছে নতুন দিগন্ত। বিশ্বের একতৃতীয়াংশ মানুষ আজ রয়েছে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। কিন্তু এখনও জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ পুঁজিবাদী ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণ থেকে মুক্ত নয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আজও প্রবল, পরাক্রান্ত। তাই দুনিয়া জুড়ে মে দিবসের যে বিজয় অভিযান সেখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে সমাজতন্ত্রের সপক্ষে ও পুঁজিবাদ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির বৈপ্লবিক সংগ্রাম। এই সংগ্রামী চেতনা ও চরিত্রই শ্রমজীবীর অহংকার। মে দিবস হচ্ছে গোটা পৃথিবীর শ্রমজীবি সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সুচনা করার দিন। মে দিবস আজ আর শ্রমিকের কাজের ঘন্টা কমানোর দাবির আন্দোলন নয়। মে দিবস এখন শ্রমিকশ্রেণীর সামনে নতুন দিনের আলো। মে দিবস আজ দুনিয়ার মেহনতি মানুষের সংগ্রামের দিন, সৌভ্রাতৃত্বের দিন। সমাজতন্ত্র কায়েম করার শপথ গ্রহণের দিন। শ্রমজীবী মানুষের উৎসব ও দিন বদলের দিন। মে দিবস জাগরণের গান, সংগ্রামে ঐক্য ও শোষণ মুক্তির অঙ্গীকার গ্রহণের দিন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট