সোমবার ● ১ মে ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » অবহেলার কচুরিপানা এখন সম্পদ
অবহেলার কচুরিপানা এখন সম্পদ
প্রকাশ ঘোষ বিধান :
কচুরিপানা একটি জলজ উদ্ভিদ। কচুরিপানা মুক্তভাবে ভাসমান বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। এর আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকা। সাতটি প্রজাতি আছে এবং এরা মিলে আইকরনিয়া গণটি গঠন করেছে। পুরু, চকচকে এবং ডিম্বাকৃতির পাতাবিশিষ্ট কচুরিপানা পানির উপরিপৃষ্ঠের ওপর ১ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর কাণ্ড থেকে দীর্ঘ, তন্তুময়, বহুধাবিভক্ত মূল বের হয়, যার রং বেগুনি-কালো। একটি পুষ্পবৃন্ত থেকে ৮-১৫ টি আকর্ষণীয় ৬ পাঁপড়ি বিশিষ্ট ফুলের থোকা তৈরি হয়। কচুরিপানা দেখতে গাঢ় সবুজ হলেও এর ফুলগুলো সাদা পাপড়ির মধ্যে বেগুনি ছোপযুক্ত এবং মাঝখানে হলুদ ফোঁটা থাকে। সাদা এবং বেগুনি রঙের মিশেলে এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে। সাদা পাপড়ির স্থলে কোথাও হালকা আকাশি পাপড়িও দেখতে পাওয়া যায়। পুরোপুরি ফুল ফোটার আগে একে দেখতে অনেকটা নলাকার দেখায়। পাপড়িগুলোর মাঝখানে পুংকেশর দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিটি ফুলে ছয়টি করে পাপড়ি দেখা যায়। প্রায় সারা বছরই কচুরি ফুল ফুটতে দেখা যায়। কচুরি ফুলের মুগ্ধতায় আমাদের মধ্যে প্রকৃতি প্রেম জাগ্রত করে। পুকুরভরা কচুরি ফুল, যেন প্রদীপ জ্বলছে, ময়ূরের পালকের মত দেখতে কচুরিপানা ফুল।
গ্রামবাংলার অতি পরিচিত সাধারণ একটি জলজ উদ্ভিদ কচুরিপানা। বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক এলাকায় নদ-নদী, পুকুর, জলাশয়, হাওর বা নিন্মাঞ্চলে সচরাচর কচুরিপানা দেখতে পাওয়া যায়। কচুরিপানা দক্ষিণ পাকিস্তানের সিন্ধের প্রাদেশিক ফুল। চাঁদপুর অঞ্চলে এই উদ্ভিদকে কস্তুরি বলে। ইতিহাস থেকে জানা যায় এর ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে জর্জ মরগ্যান নামে ব্রাজিলীয়ান এক পাট ব্যবসায়ী বাংলায় নিয়ে এসেছিলেন আমাজন এলাকার এই উদ্ভিদটি। কচুরিপানার অর্কিডসদৃশ ফুল দেখে সবাই মুগ্ধ হয়।
কচুরিপানা খুবই দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে। এটি প্রচুর পরিমাণে বীজ তৈরি করে যা ৩০ বছর পরও অঙ্কুরোদগম ঘটাতে পারে। কচুরিপানা রাতারাতি বংশবৃদ্ধি করে এবং প্রায় দু’ সপ্তাহে দ্বিগুণ হয়ে যায়।ধারণা করা হয় কচুরিপানার অর্কিড-সদৃশ ফুলের সৌন্দর্যপ্রেমিক এক ব্রাজিলীয় পর্যটক ১৮শ’ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলায় কচুরিপানা নিয়ে আসেন। তারপর তা এত দ্রুত বাড়তে থাকে যে ১৯২০ সালের মধ্যে বাংলার প্রায় প্রতিটি জলাশয় কচুরিপানায় ভরে যায়। নদ-নদীতে চলাচল দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে আর জলাভূমির ফসল আমন ধান আর পাট চাষ অসম্ভব হয়ে পড়ে, ফলে বাংলার অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দেয়। ব্রিটিশ ভারতে কচুরিপানাই একমাত্র উদ্ভিদ, যা দমনের জন্য কচুরিপানা নির্মূল আইন ১৯৩৬ প্রণীত হয়।
কচুরিপানা আমাদের বেশ কিছু উপকারও করে থাকে। এটি এখন প্রধানত সার হিসেবেই অধিক ব্যবহৃত হয়। বর্ষাকালে বন্যা আক্রান্ত অঞ্চলে গবাদি পশুর খাদ্য জোগায়। হাওরাঞ্চলসংলগ্ন এলাকায় বাঁশ দিয়ে আটকে রেখে ঢেউয়ের আঘাত থেকে ভিটামাটি রক্ষায় ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া পানিতে স্তূপীকৃত পচা কচুরিপানার ওপরে ভাসমানভাবে নানা রকম শাক-সবজিও ফলানো যায়। ফলে চাষিরা পানিতে ভাসমান কচুরিপানার স্তূপগুলোকে কৃষিকাজে ব্যবহার করে।
কচুরিপানাকে শুঁকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যও তৈরি করা হচ্ছে। কচুরিপানা থেকে তৈরি হচ্ছে টব, ফুলদানি, পাটি, ট্রে, ফলঝুড়ি, ডিম রাখার পাত্র, পাপোশ, মোড়া, টুপি, আয়নার ফ্রেম, ডাইনিং টেবিলের ম্যাটসহ প্রায় ২০ ধরনের পণ্য। কচুরিপানা প্রকৃতি ও মানুষের জীবনে কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও অসাধারণ অনেক কিছু কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।এর ব্যবহার যত বাড়বে দেশের অথনীতি তত উন্নত হবে।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট