বৃহস্পতিবার ● ১০ আগস্ট ২০২৩
প্রথম পাতা » সংস্কৃতি ও বিনোদন » আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের জন্মবার্ষিকী আজ, জন্মসাল নিয়ে বিভ্রান্তি !
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের জন্মবার্ষিকী আজ, জন্মসাল নিয়ে বিভ্রান্তি !
ফরহাদ খান, নড়াইল ; আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ১০০তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়ায় বাবা মেছের আলী ও মা মাজু বিবির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বরেণ্য এই মানুষটি ছেলেবেলা থেকে দারিদ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠেন।
এদিকে, সুলতানের জন্মবর্ষ নিয়ে এবার বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট সুলতানের জন্মদিন উল্লেখ করে মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর পক্ষ থেকে ‘জন্মশতবর্ষ’ উপলক্ষে চিঠিপত্র করা হয়েছে। তবে সুলতান ফাউন্ডেশনসহ স্থানীয়দের মতে, ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট এস এম সুলতান জন্মগ্রহণ করেন। প্রতিবছর এ হিসেবে জন্মবার্ষিকী পালন হয়ে থাকে। সেই হিসেবে এবার সুলতানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী। এ বিভ্রান্তি ছাপিয়ে এবার বড় পরিসরে জন্মশতবর্ষ পালন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, জেলা প্রশাসন, সুলতান ফাউন্ডেশন ও সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালার উদ্যোগে দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
সুলতানের জীবনাদর্শ থেকে জানা যায়, ১৯২৮ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা শুরু করেন। স্কুলের অবসরে রাজমিস্ত্রি বাবাকে কাজে সহযোগিতা করতেন এবং মাঝে মাঝে ছবি আঁকতেন শিশু সুলতান। ১৯৩৩ সালে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় জমিদার শ্যামাপ্রাসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি এঁকে তাক লাগিয়ে দেন। মুগ্ধ হন শ্যামাপ্রাসাদসহ নড়াইলের তৎকালীন জমিদাররা। পড়ালেখা ছেড়ে ১৯৩৮ সালে চলে যান ভারতের কলকাতায়। চিত্রসমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে তার (সুলতান) পরিচয় হয়। অ্যাকাডেমিক যোগ্যতা না থাকা সত্তে¡ও সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশে ১৯৪১ সালে ভর্তি হন কলকাতা আর্ট স্কুলে। ১৯৪৩ মতান্তরে ১৯৪৪ সালে কলকাতা আর্ট স্কুল ত্যাগ করে ঘুরে বেড়ান এখানে-সেখানে। কিছুদিন কাশ্মীরের পাহাড়ে উপজাতিদের সাথে বসবাস এবং তাদের জীবন-জীবিকা ভিত্তিক ছবি আঁকেন সুলতান। ১৯৪৫ মতান্তরে ১৯৪৬ সালে ভারতের সিমলায় প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের লাহোরেও চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহ। ১৯৫০ সালে চিত্রশিল্পীদের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমেরিকা যান সুলতান। এরপর ইউরোপে বেশ কয়েকটি একক ও যৌথপ্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এ সময় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, সালভেদর দালি, পল ক্লীসহ খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীদের ছবির পাশে এসএম সুলতানের ছবি স্থান পায়। ১৯৫৩ সালে নড়াইলে ফিরে আসেন সুলতান। শিশু-কিশোরদের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি চারুকলা শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। ১৯৬৯ সালের ১০ জুলাই ‘দি ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্বোধন করেন যশোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইনাম আহম্মদ চৌধুরী। ১৯৮৭ সালে স্থাপিত হয় ‘শিশুস্বর্গ’। অবশ্য অনেক আগেই স্বপ্নের শিশুস্বর্গ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এসএম সুলতান।
এদিকে, সুলতান তার সঞ্চিত অর্থ দিয়ে ১৯৯২ সালে ১০ লাখ মতান্তরে ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট দ্বিতলা নৌকা তথা ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গ নির্মাণ করিয়েছিলেন। সুলতান তার শিল্পকর্মের মাধ্যমে খেটে খাওয়া মানুষ এবং সংগ্রামী জীবনের কথাই বেশি চিত্রিত করেছেন। রয়েছে পরিবেশবন্ধু বৃক্ষরোপনের ছবিও।
চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি বাঁশি এবং সুরযন্ত্র বাজাতেও পটু ছিলেন তিনি। সুলতান বিষধর সাপ, ভল্লুক, বানর, খরগোশ, মদনটাক, ময়না, গিনিপিক, মুনিয়া, ষাঁড়সহ বিভিন্ন পশু-পাখি পুষতেন। সুলতান হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি পছন্দ করতেন না বলে জানিয়েছেন সুলতানভক্তরা।
চিত্রশিল্পের মূল্যায়ন হিসেবে ১৯৮২ সালে ‘একুশে পদক’, ১৯৮৪ সালে ‘রেসিডেন্ট আর্টিস্ট’ ১৯৮৬ সালে ‘বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা’ এবং ১৯৯৩ সালে ‘স্বাধীনতা পদক’ পেয়েছেন। এছাড়াও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’, নিউইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার লাভ করেন। অসুস্থ অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জন্মভূমি নড়াইলে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
এস এম সুলতান ফাউন্ডেশনের সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরী জানান, বরেণ্য শিল্পী এসএম সুলতানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সংগ্রহশালা চত্বরে আজ (১০ আগস্ট) সকালে কোরআনখানি অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বেলা ১১টায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি, এস এম সুলতানের সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি, বরেণ্য শিল্পীদের আর্টক্যাম্প, বরেণ্য শিল্পীদের তত্ত¡াবধানে শিশু চিত্রকর্মশালা, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, শিশুদের নিয়ে চিত্রা নদীতে নৌকা ভ্রমণ, এস এম সুলতানের চিত্রকর্মের পর্যালোচনা, আলোচনা সভা এবং এস এম সুলতানের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘আদমসুরত’ প্রদর্শন করা হবে। এছাড়া শিশুদের অঙ্কিত চিত্রকর্ম নিয়ে ১০০ বর্গফুট দৈর্ঘ্যরে ছবি প্রদর্শন করা হবে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, বরেণ্য চিত্রশিল্পী হাশেম খানসহ খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীরা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, জেলা প্রশাসন, সুলতান ফাউন্ডেশন ও সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালার উদ্যোগে দিনব্যাপী এসব কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।