শিরোনাম:
পাইকগাছা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১

SW News24
বুধবার ● ১৬ আগস্ট ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » মশা আতংকে দেশবাসী
প্রথম পাতা » মুক্তমত » মশা আতংকে দেশবাসী
২৬৩ বার পঠিত
বুধবার ● ১৬ আগস্ট ২০২৩
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

মশা আতংকে দেশবাসী

 

প্রকাশ ঘোষ বিধান

পৃথিবীতে সবথেকে ভয়ঙ্কর রোগের জীবানুগুলির বেশির ভাগ মশার মাধ্যমে ছড়ায়।মশা ভয়ঙ্কর রোগজীবাণু সংক্রামক।মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ফাইলেরিয়া, পীত জ্বর, জিকা ভাইরাস প্রভৃতি রোগ হয়ে থাকে। মশা বাহিত রোগগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিপজ্জনক, এ কারণে প্রতিবছর বহু মানুষের মৃত্যু হয়।  

মশা মারতে কামান দাগা, ছোট কাজের জন্য বড় আয়োজন করা কে বোঝানো হয়।তারপরও মশা তাড়াতে সবাইকে হিমশিম খেতে হচ্ছ। গ্রামে কিংবা শহরে সব জায়গাতেই মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ।  মশার উৎপাতের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। এ পতঙ্গ নিধনের জন্য কয়েল, অ্যারোসলসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও অনেক সময় কাজের কাজ কিছুই হয় না। নিন্মমানের কয়েল, অ্যারোসল ব্যবহারে মশা মরছে না।  মনে হয় যেন উৎপাত আরও বেড়ে গেছে। তবে মশা তাড়ানো বড় ঝামেল। বর্ষায় আরও উপদ্রব বাড়ে মশা-মাছির। সেই অনুযায়ী বেড়ে যায় রোগ-ব্যাধিও। মশার ধূপ, ওষুধ, কয়েল, স্প্রে নানা রকম উপায়ে মশা তাড়ানোর চেষ্ঠা করা হয়। কিন্তু টাকা খরচ হওয়া ছাড়া আর কোনও লাভ হয় না অনেক সময়।     

প্রতিবছর ২০ আগস্ট বিশ্ব মশা দিবস পালিত হয়। ১৯৩০-এর দশক থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৮৯৭ সালের ২০শে আগস্ট চিকিৎসক রোনাল্ড রস অ্যানোফিলিস মশা বাহিত ম্যালেরিয়া রোগের কারণ আবিষ্কার করেছিলেন।পরবর্তীকালে তিনি এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।মশা দিবস পালন করা হয় মূলত চিকিৎসক রোনাল্ড রসের আবিষ্কারকে সম্মান জানানোর জন্য।যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন দিবসটি প্রথম পালন করা শুরু করে।

সারা বিশ্বব্যাপী মশা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মশা ও মশা বাহিত রোগ সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করে তোলা। বিভিন্ন ভয়াবহ সব অসুখের মধ্যে মশা বাহিত ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু উল্লেখযোগ্য। তাই ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি মশাবাহিত রোগের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে বিশেষভাবে সচেতন করার জন্য এই দিন সারা বিশ্ব জুড়ে পালিত হয়। মশা বাহিত রোগ থেকে সাবধান হওয়ার জন্য, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এই দিনে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে বেশ কিছু সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হয়।

---মশাবাহিত রোগ হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের ইতিহাসে অসুস্থতা এবং মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ১৯ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত কেউই বুঝতে পারেনি যে মশা রোগের ভেক্টর ছিল। প্রথম সাফল্য আসে ১৮৭৭ সালে যখন ব্রিটিশ ডাক্তার প্যাট্রিক ম্যানসন আবিষ্কার করেছিলেন যে একটি কিউলেক্স প্রজাতির মশা মানুষের ফাইলেরিয়াল রাউন্ডওয়ার্ম বহন করতে পারে। পরবর্তী দুই দশকে তিনি এবং ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য গবেষকরা ম্যালেরিয়াতে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন, যা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং নাতিশীতোষ্ণ দেশগুলোতে একটি প্রধান ঘাতক। তারা আস্তে আস্তে মানুষ এবং মশার মধ্যে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ এবং জীববিজ্ঞানের জটিল সমীকরণ বুঝতে শুরু করেন।

১৮৯৪ সালে, ম্যানসন ম্যালেরিয়া প্যারাসাইটের সম্ভাব্য ভেক্টর হিসেবে ‘মশা বিষয়ক অধ্যয়ন’ করতে ভারতীয় মেডিকেল সার্ভিসের মেডিকেল অফিসার রোনাল্ড রসকে রাজি করান। বছরের পর বছর নিরলস গবেষণার পর রস শেষ পর্যন্ত ১৮৯৭ সালে প্রমাণ করেন যে অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া পরজীবী বহন করতে পারে। তিনি তার আবিষ্কারের দিন, ২০ আগস্ট, ১৮৯৭-কে ‘মশা দিবস’ বলে অভিহিত করেছিলেন। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন পরে তার আবিষ্কারের তাৎপর্য চিহ্নিত করতে ২০ আগস্ট বিশ্ব মশা দিবসের নামকরণ করেন, যা প্রতি বছর পালিত হয়।

ম্যালেরিয়া নির্মূলে নানা উদ্যোগ আর চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়নের কারণে কমে এসেছে এই রোগে মৃত্যু। তবে, এখনও মশাবাহিত রোগে প্রতি বছর বিশ্বে মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। গবেষণা বলছে, গত ৩০ বছরে ডেঙ্গু সংক্রমণ হার বেড়েছে ৩০ গুণ, ১০০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়েছে এই রোগ।

 গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশা শনাক্ত করা হয়েছে তারমধ্যে ঢাকাতে রয়েছে ১৪ প্রজাতি। উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়া থাকার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উত্তম জায়গা। বাংলাদেশ মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস।

মশা এক প্রকারের ছোট মাছি প্রজাতির পতঙ্গ। মশা নেমাটোসেরা মাছি বর্গের অন্তর্ভুক্ত। একটি মশার ওজন সাধারণত ২.৫ মিলিগ্রাম হয়ে থাকে। একটি মশার জীবনচক্র চারটি পর্যায়ে বিভক্ত: ডিম,শূক,মুককীট এবং পূর্ণাঙ্গ মশা। শুধুমাত্র স্ত্রী মশারাই স্তন্যপায়ী প্রাণী,পাখি,সরীসৃপ, উভচর প্রাণী এবং এমনকি কিছু মাছের রক্ত পান করে থাকে। পুরুষ মশারা কিন্তু মানুষ বা প্রাণীদের কামড়ায় না কিংবা রক্ত শোষণ করে না। একটি মশা একবারে ০.০০১ থেকে ০.০১ মিলিলিটার রক্ত পান করতে পারে। একবারে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরের সব রক্ত শোষণ করে ফেলতে ১২ লক্ষ মশা প্রয়োজন। ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হতে সময় লাগে পাঁচ দিনের মতো ।কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ মশা হতে সময় লাগে ৪০ দিন বা কিছু কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে আরও বেশি। একটা মশা প্রায় ৫ থেকে ৬ মাস বেঁচে থাকতে পারে। স্ত্রী মশা পানির ওপরে উড়া-উড়ি করে এবং পানিতে ডিম ছাড়ে। স্ত্রী মশা বদ্ধস্থানে বা জলাশয়ে ডিম পাড়ে। পূর্ণাঙ্গ একটি স্ত্রী মশা তার জীবনচক্রে ১০০-২০০টি ডিম দিতে পারে। মশার কোনো দাঁত নেই। মশা মুককীত তার পেটের সাহায্যে সাঁতার কাটতে পারে। মশার ডানাগুলো প্রতি সেকেণ্ডে প্রায় ৩০০ থেকে ৬০০ বার পর্যন্ত ঝাপটায়। মশারা সাধারণত,ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১৫০ মাইল পর্যন্ত গতিবেগে উড়তে পারে। পৃথিবীতে ৩,৫০০ এর বেশি প্রজাতির মশা রয়েছে।

প্রতিবছর প্রায় ৫১.৫ কোটি মানুষ মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হন এবং প্রায় দশ থেকে ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান যাদের মধ্যে বেশিরভাগই আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের শিশু। বাংলাদেশসহ পৃথিবীব্যাপী মশাবাহিত রোগের অন্যতম হলো ম্যালেরিয়া। অ্যানোফিলিস মশার সাতটি প্রজাতি বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। ম্যালেরিয়া নির্মূলে নানা উদ্যোগ আর চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়নের কারণে এই রোগে মৃত্যু আগের তুলনায় কমেছে। তবে এখনও মশাবাহিত রোগে প্রতি বছর বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে ।

বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগগুলোর অন্যতম হলো ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস। এর মধ্যে গত কয়েক বছরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েছে।দেখতে বেশ ক্ষুদ্র হলেও হরহামেশাই ঘাতকের রূপ নিতে পারে মশা। মশাবাহিত রোগের মধ্যে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়া, জিকা ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস উল্লেখযোগ্য। মশাবাহিত অন্যান্য রোগের তুলনায় বাংলাদেশে মূলত ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ তুলনামূলক বেশি। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ একটু কম। পার্বত্য চট্টগ্রামে এই রোগী বেশি পাওয়া যায়। ম্যালেরিয়ার বাহক হলো অ্যানোফিলিস মশা। এটি স্বচ্ছ পানিতে হয়। জ্বর দেখে এটি শনাক্ত করা হয়। ওষুধ খেলেই ম্যালেরিয়া সেরে যায়।

 জানামতে, পৃথিবীতে তিন হাজারের বেশি প্রজাতির মশা রয়েছে, যদিও মাত্র তিন ধরনের মশা মানুষের মধ্যে রোগ ছড়ানোর জন্য দায়ী। এনোফিলিস মশা একমাত্র প্রজাতি, যা ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহন করে। কিউলেক্স জাতীয় মশারা ওয়েস্টনাইল ভাইরাস, জাপানিজ এনসেফালিটিস ভাইরাস, সেন্ট লুই এনসেফালিটিস ভাইরাস এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফাইলেরিয়াসিস ও এভিয়ান ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহন করে। তৃতীয় প্রজাতির মশা, যারা এডিস বা টাইগার মসকিউটো নামে পরিচিত; ইয়েলো ফিভার, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং জাপানিজ এনসেফালাইটিস ভাইরাস বহন করে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বরে মারা যাওয়ার ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। মশা দিবসে, মশার জন্য আবাস না গড়ে, তাদের তাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আর মশা তাড়াতে প্রাকৃতিক পদ্ধতিই হতে পারে বেশ কার্যকর। নিম তেল শরীরে লাগিয়ে নিলে মশার কামড় থেকে রেহাই পাওয়া যায়। নিমের গন্ধে দূরে মশা থাকে। শুধু নিমপাতাও ঘরে রেখে দিলেও মশার উপদ্রব কমবে।ঘরে টবে কয়েকটি তুলসী গাছ রাখলে  মশা পালাবে। মশা কর্পূরের গন্ধ একেবারেই সহ্য করতে পারে না একটি ৫০ গ্রামের কর্পূরের ট্যাবলেট একটি ছোট বাটিতে রেখে বাটিটি পানি দিয়ে পূর্ণ  করে ঘরের কোণে রেখে দিলে মশা পালাবে।  একটি লেবু মাঝ থেকে কেটে  তার অর্ধেক কাটা লেবুর ভেতরের অংশে অনেকগুলো লবঙ্গ গেঁথে দিয়ে লেবুর টুকরোগুলো একটি প্লেটে রেখে ঘরের কোণায় রেখে দিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে কোনো মশা থাকবে না। কয়েকটি রসুনের কোয়া থেতলে পানিতে সেদ্ধ করে ওই পানি সারা ঘরে স্প্রে করে দিলেই মশার যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে ফুলহাতা শার্ট, হাতে পায়ে মোজা, দিনে মশারির ভেতর ঘুমানো এবং ঘরে অফিসে  অ্যারোসেল ব্যবহারের পরামর্শ দেন  কীটতত্ত্ববিদরা।

মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারি-বেসরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ের সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। বৃষ্টির পানি জমে মশা জন্মে। বাড়ির কোথাও পানি জমে গেলে নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার করুন। মশার কামড়ে শুধু যন্ত্রণাই না, ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গুও হয়, তাই সচেতন হন, মশার যন্ত্রণা থেকে দূরে থাকুন। সপ্তাহে একদিন নিজেদের বাড়ির ভেতর এবং বাইরে ঘুরে দেখতে হবে কোথাও কোনো পাত্রে পানি জমা আছে কিনা,যদি থাকে তাহলে সেটি ফেলে দিতে হবে অথবা উল্টিয়ে রাখতে হবে অথবা সেখানে মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ মানুষের সচেতনতা এবং সম্পৃক্ততা মশা নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে এবং মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকবে পরিবার ও দেশ। মশাবাহিত  এই রোগ থেকে মুক্ত থাকার প্রধান ও অন্যতম উপায় হলো মশা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। সঠিকভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ  করতে পারলে আমরা রক্ষা পেতে পারি মশাবাহিত ভয়াবহ রোগ থেকে। তাই মশা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি নিজেকে সম্পৃক্ত করা জরুরি।

 লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ