শিরোনাম:
পাইকগাছা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩১

SW News24
মঙ্গলবার ● ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সাক্ষরতা দিবস ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সাক্ষরতা দিবস ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
২৪৮ বার পঠিত
মঙ্গলবার ● ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

সাক্ষরতা দিবস ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

প্রকাশ ঘোষ বিধান

---

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার সঙ্গে শিক্ষা কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সেই জাতি তত বেশি সভ্য ও উন্নত।  শিক্ষা জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির চাবিকাঠি। শিক্ষা অজ্ঞতা ও কুসংস্কার দূর করে। মানুষকে যুক্তিনিষ্ঠ, কর্মঠ ও আত্মনির্ভরশীল করে তালো।

পৃথিবীর একটি মানুষও সাক্ষরতার বাইরে থাকবে না। টিপসই কে পৃথিবীব্যাপী নির্মূল করার জন্য বিশ্ব সাক্ষরতা দিবস পালনের অন্যতম মূল লক্ষ্য । এই লক্ষ্য নিয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা,  বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ঘোষিত একটি আন্তর্জাতিক দিবস পালনের ঘোষণা করা হয়। এরে আওতায় ১৯৬৬  সালের ২৬ শে অক্টোবর ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ১৪ তম অধিবেশনে ৮  সেপ্টেম্বর তারিখে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো দিবসটি উদযাপিত হয়। বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

একটি দেশ, জাতি ও সমাজের উন্নয়নের জন্য দেশের প্রতিটি নাগরিককে শিক্ষার আলোয় শিক্ষিত করা একান্ত প্রয়োজন। সমাজের শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে এবং শিক্ষার উপর যে সকলের অধিকার আছে তা মনে করায় দেওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাক্ষর দিবস। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হলো জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা  বা ইউনেস্কো-ঘোষিত একটি আন্তর্জাতিক দিবস। দিবসটির লক্ষ্য ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং সমাজের কাছে সাক্ষরতার  গুরুত্ব তুলে ধরা। বর্তমানে জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র এ দিবসটি উদ্যাপন করে থাকে। সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিশ্ব সাক্ষরতা দিবস পালন করা হয়।

আভিধানিক অর্থে সাক্ষরতা হল অক্ষর পরিচিতি, লেখা ও পড়ার ক্ষমতা।  কোনা ব্যক্তি যে কোনা বিষয় পড়ে, সেটা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে সক্ষম হয় তাহলে তাকে সাক্ষর বলে। তবে শুধু অক্ষরজ্ঞানসম্পন্নদের সাক্ষর বলা হয় না, এর সঙ্গে জীবনধারণ, যোগাযোগ দক্ষতা ও ক্ষমতায়নের দক্ষতাও যুক্ত হয়েছে। একসময় ছিল যখন কেউ নাম লিখতে পারলেই তাকে সাক্ষর বলা হতো।  বর্তমানে যিনি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোটো বাক্য পড়তে পারবেন, সহজ ও ছোটো বাক্য লিখতে পারবেন এবং দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ হিসাবনিকাশ করতে পারবেন তাকে আমরা সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন বলা হবে। ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো সাক্ষরকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করেছে।

প্রথিবীতে বহু ভাষা প্রচলিত রয়েছে।পৃথিবীতে বর্তমানে আনুমানিক ৭ হাজার ৯৭টি ভাষা বেঁচে আছে। এর মধ্যে দুই হাজার ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা এক হাজারেরও কম। এ ছাড়া মোট ভাষার মাত্র অর্ধেকের আছে লিখিত রূপ। এসব ভাষায় ব্যবহার করা হয় ৪৬ ধরনের বর্ণমালা। বাকিগুলো মৌখিকভাবেই চর্চিত হয়। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাকেন্দ্রিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী প্রতি দুই সপ্তাহে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচেছ একটি করে ভাষা। সেগুলোর অবস্থান কোথায় আছে সেগুলোকেও বুঝতে হবে।

সাক্ষরতা অর্জনের  ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে সত্য কিন্তু এখনও বহু চ্যালেঞ্জ থেকে গেছে। সাক্ষরতার ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন হয়েছে সেটি অসম, দেশে দেশে মানুষে মানুষে এর ভিন্নতা স্পষ্ট। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় ও ডিজিটালাইজড বিশ্বে বহুভাষিকতার বৈশিষ্টাবলি, রাজনৈতিক বাস্তবতায় এর প্রভাব ও ফল কী হতে পারে বহুভাষিক প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্যসব ভাষার অন্তর্ভুক্তি ঘটানোও সাক্ষরতা দিবসের উল্লেখযোগ্য একটি দিক।

সাক্ষরতা হলো মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহের একটি। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ঘোষিত জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার ধারা ২৬-এ এই অধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। এই ঘোষণায় বলা হয়, শিক্ষা প্রতিটি মানুষের একটি অধিকার। এই শিক্ষা মৌলিক স্তব পর্যন্ত হবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। এছাড়া কারিগরি ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগও বিস্তৃত হতে হবে। জাতিসংঘের এই ঘোষণার পর সদস্যভুক্ত প্রায় প্রতিটি দেশ সাংবিধানিকভাবে সাক্ষরতাকে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা ১৭-তে দেশের প্রতিটি নাগরিকের সাক্ষরতা প্রদানের বিধান রয়েছে। সবার জন্য শিক্ষার মূল লক্ষ্য প্রত্যেক নিরক্ষর ব্যক্তিকে সাক্ষর করে তোলা।

সারা বিশ্বে প্রায় একশ কোটি লোকেরও বেশি নিরক্ষর। আর এ একশ কোটি লোকের মধ্যে প্রায় সাতষট্টি কোটি নিরক্ষর লোকের বাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। ২০১৬ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পৃথিবীতে ৭৭৫ মিলিয়ন মানুষ সাক্ষরতার মৌলিক ধারণা থেকে দূরে রয়েছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন নয়। এই ২০ শতাংশের মধ্যে আবার প্রায় ৬৬ শতাংশ হচেছ নারী। প্রায় ৭৫ মিলিয়ন শিশু এখনও হয় বিদ্যালয়ে যায়নি কিংবা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে। সাক্ষরতার সঙ্গে উন্নয়নের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এদেশে সাক্ষরতার হার বর্তমানে ৭৩.৯ শতাংশ এবং আমাদের মাথাপিছু আয় ১৯০৯ ডলার।

মানবসভ্যতার চরম উৎকর্ষের এই যুগে এ তথ্যটি নিরাশাব্যঞ্জক যে, সাক্ষরতার হার দিন দিন বাড়লেও বর্তমানে বিশ্বের ২৬ কোটির বেশি শিশু-কিশোর স্কুলে যায় না এবং প্রায় ৬২ কোটি মানুষ সাক্ষরতা ও হিসাব-নিকাশে ন্যূনতম দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। অন্যদিকে প্রযুক্তিগত বিস্ময়কর উদ্ভাবনের ফলে পুরনো ধাঁচের সাক্ষরতা ও হিসাবজ্ঞান নতুন পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থান খুঁজে পেতে এবং সামাজিক-আর্থিক-পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তেমন কাজে আসছে না। এ অবস্থায় শুধু সাক্ষরতা অর্জন নয়, প্রযুক্তিগত জ্ঞানও বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে মানবজাতির জন্য।

বাংলাদেশে তাই শুধু শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রাই যথেষ্ট নয়, জনসংখ্যাকে যথার্থ অর্থেই সম্পদে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা রয়েছে ৪ নম্বরে। এখানে অন্তর্ভুক্তমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা এবং সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এতে ২০৩০ সালের মধ্যে দক্ষ ও মানসম্মত শিক্ষক-সংখ্যা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের কথাও বলা হয়েছে। আশার কথা, আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, এনজিও ও সুশীলসমাজ এসডিজির ৪ নম্বর লক্ষ্য নিয়ে নানামুখী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রাটি অর্জিত হলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে উন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কাজটি সহজ হয়ে যাবে বলা যায়।

নিরক্ষরতা একটি অভিশাপ। নিরক্ষরতা জাতিকে রুগণ, নিরুদ্যম ও গতিহীন করে তোলে। নিরক্ষর মানুষ জীবনে দুর্দশা ও বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি পায় না। আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিরক্ষর। তারা সমাজের অপশক্তির হাতে শোষণ, নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হয়।তাদের দুর্বিষহ, বিপন্ন ও মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় । নিরক্ষরতা নামক সামাজিক ব্যাধি ও পশ্চাৎপদতা থেকে দেশকে মুক্ত করতে দেশে সাক্ষরতা আন্দোলন শুরু হয়েছে। সরকার নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। সবার জন্য শিক্ষা, উপআনুষ্ঠানিক শিক্ষা ইত্যাদি এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে হলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে শিক্ষিত সচেতন নাগরিককে। তবেই আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফল হবে।

লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ