শনিবার ● ২৮ অক্টোবর ২০২৩
প্রথম পাতা » বিশেষ সংবাদ » বঙ্গবন্ধু টানেলের আদ্যপান্ত
বঙ্গবন্ধু টানেলের আদ্যপান্ত
একসময় চট্টগ্রামের আনোয়ারা থেকে শাহ আমানত সেতু হয়ে সড়কপথে শহরে আসতে সময় লাগতো অন্তত দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। এখন সেই পথ ও সময় কমিয়েছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এই টানেলের আনোয়ারা প্রান্ত থেকে প্রবেশ করে পতেঙ্গা প্রান্তে আসতে সময় লাগে মাত্র দুই থেকে আড়াই মিনিট। দুই পাড় সংযুক্ত করা এই টানেল চালু হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব কমবে অন্তত ৪০ কিলোমিটার।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় কমেছে আরও আগেই। চার লেন চালু হওয়ার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যোগাযোগ স্বচ্ছন্দ হয়েছে। তাতে উপকৃত হয়েছেন কক্সবাজারগামী যাত্রীরাও। তবে এখন কক্সবাজার যেতে হলে চট্টগ্রাম শহরের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আর তাতে অনেক সময় ব্যয় হয়। সড়কপথে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ৪১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৬৪ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। তাই ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ পথ।
বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মিত হলে ঢাকার যানবাহনগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট হয়ে বন্দর টোল রোডের সঙ্গে নির্মিত আউটার রিং রোড-পতেঙ্গা হয়ে কর্ণফুলী টানেল ব্যবহার করলে চট্টগ্রামের দিকে পথ কমবে প্রায় ১৫ কিলোমিটার। তা ছাড়া কর্ণফুলী টানেল হয়ে আনোয়ারা উপজেলার সিইউএফএল ঘাট-চাতরি চৌমুহনী-বাঁশখালী-পেকুয়ার মগনামা হয়ে সরাসরি কক্সবাজার সদরে যুক্ত হলে কক্সবাজারের দিকে সড়ক কমবে আরও প্রায় ৩০ কিলোমিটার।
পরিকল্পনাধীন এই প্রকল্পে ৪০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে আনোয়ারা উপজেলা সংযোগ সড়কসহ কর্ণফুলী টানেল সংযোগ সড়ককে ছয় লেনে উন্নীত করা হবে। এছাড়া টানেল হয়ে আনোয়ারা-বাঁশখালী-পেকুয়া হয়ে কক্সবাজার সদর পর্যন্ত কক্সবাজার বিকল্প সড়ক নামে আরো একটি সড়ক প্রকল্পের ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) সূত্র বলছে, কর্ণফুলী টানেল চালু হলে প্রথম বছরেই ৬৩ লাখ গাড়ি টানেলের ভেতর দিয়ে চলাচল করবে। এই চাপ সামলাতে হবে সংযোগ সড়ক গুলোকে। শিকলবাহা-আনোয়ারা সড়কটি সরাসরি কোন বিভাগীয় সদরকে সংযুক্ত না করলেও অর্থনৈতিক গুরত্ব বিবেচনায় এটি বিশেষ প্রাধান্য পাচ্ছে। একটি জাতীয় মহাসড়ক, একটি আঞ্চলিক সড়ক ও কর্ণফুলী টানেল হয়ে এটি চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে।
পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে মাতারবাড়ি পাওয়ার হাব, মহেশখালী গভীর সমুদ্র বন্দর ও টেকনাফ স্থল বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে। কর্ণফুলী টানেল হয়ে যে সড়ক কক্সবাজার যাবে তা কোনো একসময় মিয়ানমার হয়ে প্রসারিত হবে চীনের কুনমিং সিটি পর্যন্ত। মহাপরিকল্পনার আওতায় চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে বিদ্যুৎ হাব।
২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায় এই প্রকল্পটি। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন এবং ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন। এরপর ২০২২ সালের ২৬ নভেম্বর টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্ত কাজের সমাপ্তি উদযাপন করা হয়।
দেশের প্রথম এই টানেল নির্মিত হচ্ছে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায়। ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা রয়েছে এই মেগা প্রকল্প। বর্তমানে এর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৮ অক্টোবর টানেল উদ্বোধন করবেন।
সেতু বিভাগ জানায়, দুই টিউব সংবলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। তিনটি সংযোগপথের (ক্রস প্যাসেজ) মাধ্যমে যুক্ত থাকবে এই দুই টিউব। বিপদকালে এক টিউব থেকে অন্য টিউবে যাতায়াতের জন্য এই ক্রস প্যাসেজগুলো ব্যবহৃত হবে। কিছুদূর পরপর টানেলের দেয়ালে এই ক্রস প্যাসেজের দূরত্বের নির্দেশনা লেখা আছে। টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ভেতরের ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার।
টানেলটি কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে পশ্চিম প্রান্তে পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির কাছ থেকে শুরু হয়ে পূর্ব প্রান্তে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) এবং কর্ণফুলী সার কারখানার (কাফকো) মাঝখান দিয়ে আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছেছে। মূল টানেলের সঙ্গে পতেঙ্গা প্রান্তে শূন্য দশমিক ৫৫০ কিমি এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারসহ মোট ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে। এ ছাড়াও আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ সড়কের সঙ্গে ৭২৭ মিটার উড়ালসড়ক রয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, টানেল চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এক ধাপ এগিয়ে যাবে। টানেলকে ঘিরে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরীর এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
টানেলের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা
টানেল এর ভেতর অত্যাধুনিক ফায়ার সিস্টেম রয়েছে। পুরো টানেল মনিটরিংয়ের জন্য একটি কন্ট্রোল রুম রয়েছে। সেখান থেকে টানেলের ভেতর কী হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করা হবে। টানেলের ভেতর অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে তা কন্ট্রোল রুম থেকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ আছে।
নিরাপত্তা
টানেলে নিরাপত্তায় ১০০টির বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। টানেলে চলাচলকারী গাড়ির গতিবেগ প্রথম দিকে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের বেশি হবে না। পায়ে হেঁটে টানেল পার হওয়া যাবে না। একইভাবে মোটরসাইকেল এবং তিন চাকার যানবাহনও চলাচল করবে না টানেল দিয়ে। নির্ধারিত ওজনের বেশি ভারী যানবাহন এ টানেল দিয়ে চলতে দেওয়া হবে না। এজন্য টানেলের প্রবেশমুখে নির্মাণ করা হয়েছে ওজন স্কেল। পরিমাপের পর বেশি হলে ওই যানবাহনকে পার হতে দেওয়া হবে না। কোন যানবাহন থেকে কী ধরনের টোল নেওয়া হবে তা ইতোমধ্যে নির্ধারণ করে ফেলেছে মন্ত্রণালয়।
কোন যানের কত টোল
গত ১৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে। যানবাহনের শ্রেণি অনুযায়ী টোল হার চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সেতু বিভাগ।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী- তিন দশমিক ৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু টানেলে মোট ১২ ধরনের যানবাহনের টোল দিতে হবে। সর্বনিম্ন টোল ধরা হয়েছে ২০০ টাকা। প্রাইভেটকার পারাপারে এই টোল দিতে হবে। প্রতিবার পিকআপ পারাপারে টোল ২০০ টাকা। মাইক্রোবাসের টোল ২৫০ টাকা। ৩১ আসনের কম বাসের টোল ৩০০ টাকা। ৩২ আসনের বেশি বাসের টোল ৪০০ টাকা। তিন এক্সেল বিশিষ্ট বড় বাসের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা।
পাঁচ টন পর্যন্ত পণ্য বহনে সক্ষম ট্রাকের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০০ টাকা। আট টনের ট্রাক পারাপারে ৫০০ টাকা এবং ১১ টনের ট্রাকে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে। তিন এক্সেলের ট্রেইলারে টোল লাগবে ৮০০ টাকা। চার এক্সেলের ট্রেইলারে দিতে হবে এক হাজার টাকা। পরবর্তী প্রতি এক্সেলের জন্য বাড়তি দিতে হবে ২০০ টাকা। টানেল যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার দিন থেকে এই টোল হার কার্যকর হবে।