বুধবার ● ১৫ জুন ২০১৬
প্রথম পাতা » সাহিত্য » সমবায় আন্দোলনের পুরধা বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়
সমবায় আন্দোলনের পুরধা বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়
প্রকাশ ঘোষ বিধান
জগত বিখ্যাত বিজ্ঞানী সমবায় আন্দোলনের পুরধা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রাড়–লী সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে সমবায়ের যে সুদুর প্রসারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন বিশ্বের দরবারে তা অনন্য ও সমবায় আন্দোলনের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল নিদর্শন। গ্রামের সুদখোর-মহাজনদের করাল গ্রাস থেকে কৃষকদের সুরক্ষিত রাখাই ছিল রাড়–লী সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক এর মূল কাজ। অবিভক্ত বাংলায় রাড়–লী সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক ছিল দ্বিতীয় নিবন্ধিত ব্যাংক। প্রথম সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক নিবন্ধিত হয়েছিল মেদিনীপুর জেলায়।
১৯০৪ সালে ভারতে সমবায় বিধিবদ্ধ আইন চালু হলে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় গ্রামের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে সমবায়ের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে উদ্যোগী হন। ১৯০৬ সালে রাড়–লীসহ এলাকার ৪১টি কৃষি ঋণ দান সমবায় সমিতি গড়ে তোলেন। ১৯০৮ সালে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও তার ভাই রায় সাহেব নলিনী কান্ত রায় চৌধুরীর প্রচেষ্টায় সমবায় সমিতিগুলোকে নিয়ে রাড়–লী সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৯ সালের ১ ফেব্র“য়ারি তিনি মাত্র ২৩টি সমবায় প্রতিষ্ঠানের একীভূত করে রাড়–লী সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত হয়। সমবায় প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্দেশ্য ছিল প্রান্তিক চাষি ও বর্গা চাষিদের মহাজনী ঋণের হাত থেকে মুক্ত করা ও সমবায়ভিত্তিক সংগঠনের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব সৃষ্টি করা। কৃষি কাজে কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তা দিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ সৃষ্টি করতে একটি জমিদার পরিবারের সন্তানের পক্ষে ছিলো অত্যন্ত উদার মানসিকতা। কালচক্রে শত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বহু গুণী সমবায়ী রাড়–লী সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন। বিগত সময়কালে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সভাপতি হিসেবে অত্র ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে যে সকল গতিশীল কর্মকান্ড করেছেন তার মধ্যে রাড়–লী গ্রামে তার বাসভবন সংলগ্ন ০.৮৭ শতক জমিতে দ্বিতল ব্যাংক ভবন ও কর্মচারীদের বাসভবন। পাইকগাছা, কয়রা, তালা, আশাশুনি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সাধারণ কৃষিজীবি পরিবারের লোকজন নিয়ে কৃষি ভিত্তিক সমবায় সমিতি গঠন করে কৃষি চাষের জন্য কৃষি ঋণ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা, এ সকল থানাস্থ ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি গঠন করে ইউনিয়নে জনবহুল বাজার সংলগ্ন এলাকায় ইউনিয়নে কৃষক সমবায়ীদের মধ্যে কৃষি ঋণদান দাদন ও আদায় এবং সার, বীজ, কীটনাশক দ্রব্য বিতরণের উদ্দেশ্যে গুদামঘর, অফিস ঘর নির্মাণ করে হয়। সরকারিভাবে সার, বীজ, কীটনাশক সরবরাহ নিশ্চিতকরে কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টা করেছেন। পরবর্তীকালে সরকারের সুদৃষ্টিতে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে কৃষকদের কৃষি ঋণ বিতরণের কর্মসূচী বাস্তবায়নে বাংলাদেশে সমবায় ব্যাংকের মাধ্যমে অত্র রাড়–লী সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকে ১৮৬টি সমিতির মধ্যে ৭৬ লক্ষ টাকা ঋণ দাদন করে ছিলেন। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সময়কালে অত্র ব্যাংকের জন্য অনেক সম্পদ গচ্ছিত রেখে গেছেন। যা এখন স্বপ্নের মত মনে হয়।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পিতা হরিশচন্দ্র রায় ছিলেন দক্ষিণ বাংলার একজন জনদরদী সমাজ সংস্কারক। কৃষি কাজে সার, বীজ, সংকট, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি নানা প্রতিকুলতায় কৃষককুল দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। এসময় সুদখোর ও মহাজনদের প্রতাপ প্রতিপত্তি বেড়ে যায়। এ অবস্থা থেকে কৃষকদের পরিত্রানের জন্য হরিশচন্দ্র রাড়–লীতে লোন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে ছিলেন। সমাজের এমন পরিস্থিতিতে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সমবায় মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হন। তিনি ১৮৮২ থেকে ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত বিলাতে শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষামূলক ভ্রমনের সুযোগে পশ্চিমা সমাজে গড়ে ওঠা সমবায় সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করে ছিলেন। ঈযধৎরঃু ইবমরহং ধঃ যড়সব এ আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রফুল্ল চন্দ্র তার পিতার আদর্শে হৃদয়ে ধারণ করে গ্রামের মানুষদের সমবায় পদ্দতিতে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন।
পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তি ও দেশকে অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর করতে তার চেষ্টা ছিল নিরন্তর। তার প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালে-এ নিযুক্ত শ্রমিকদের কল্যাণে তিনি ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল কেমিক্যাল সমবায় সমিতি। শ্রমিকদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ও সঞ্চয়ী মনোভাবপন্ন হিসাবে গড়ে তোলার মানসে সমবায় পদ্ধতির উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ঐ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন। তিনি ছিলেন ব্যবসাবিমুখ বাঙালী জাতির পথ প্রদর্শক। ছাত্র সমাজকে সমবায়ের আদর্শ উদ্বুদ্ধ করে ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বঙ্গবাসী কলেজ কো-অপারেটিভ ক্যান্টিন এন্ড ষ্টোর। সমবায়ের চিন্তাকে আরও প্রসারিত করার লক্ষে কলকাতায় ১৯২টি কলেজের ছাত্রদের নিয়ে ১৯১৯ সালে স্টুডেন্ট কো-অপারেটিভ কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। কমিটিতে প্রথিতযশা সমাজ চিন্তাকেরা অর্ন্তভূক্ত হয়ে ছিলেন। ঐ সময়ের শিক্ষক সমাজের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। শিক্ষকদের দুরবস্থা থেকে মুক্তি দেয়ার লক্ষে গড়ে তোলেন ঞবধপযবৎং নবহবাড়ষবহঃ ভঁহফ সমবায় সমিতির অনুরুপে এর কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তখন কার সময়ে সীমাহীন দুভিক্ষ মোকাবেলার জন্য তিনি সর্বত্র ধর্মগোলা (সমবায় শস্য ভান্ডার) ও সমবায় পদ্ধতিতে সবাইকে সমবেত হওয়ার আহবান জানান।
সমবায় ও শিক্ষা বিষয়ে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। ১৯২০ সালের ৩১মে রাড়–লী সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের এক অধিবেশনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। তিনি বক্তৃতায় সমবায় ও শিক্ষার আইশ্যিকতা এবং প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে অতি সরল ভাষায় গ্রামের লোকদের উৎসাহিত করেন। সমবায়ের আদর্শের আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সীমাহীন নিষ্ঠা, প্রয়োগ ক্ষমতা এবং ধারাবাহিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে ১৯২১ সালে তাকে সর্বসম্মতিক্রমে দি বেঙ্গল কো-অপারেটিভ অরর্গানাইজেশন সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দুভিক্ষ মোকাবেলার সঙ্গে সঙ্গে বন্যা এবং ম্যালেরিয়া-কালাজ্বর নামক মরণব্যাধী প্রতিরোধে সমবায় পন্থা অবলম্বন করেন। সে সময় ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বর রোগ বাংলাদেশ সহ বহুদেশে অভিশাপ হিসাবে বিবেচিত হতো। ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বরের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য দি বেঙ্গল কো-অপারেটিভ এণ্টি ম্যালেরিয়া সোসাইটি গঠন করেন। ১৯২৪ সালের ৫ জুলাই দি বেঙ্গল কো-অপারেটিভ এণ্টি ম্যালেরিয়া সোসাইটির উদ্যোগে আর্ন্তজাতিক সমবায় দিবস পালিত হয়। সভাপতির ভাষনে আচার্যদেব সমবায়ের প্রাসঙ্গিকতা ও আবশ্যকতা নিয়ে যে মর্মস্পর্শী ও তত্বমূলক বক্তৃতা প্রদান করে ছিলেন তা আজও অবিস্মরণীয়। দূর্বল ও অসুস্থ শরীর নিয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বাগেরহাট, মেদিনীপুর, খুলনা, ঢাকা, বোম্বই, করাচি, লাহোর সহ বিভিন্ন শহরে সমবায় সম্মেলনের সভাপতি বা উদ্বোধক হিসাবে মানুষকে সমবায়ের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আজীবনের নির্মোহ কর্মসাধক, বিদ্যাব্রতী, জনদরদী, বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৯৪৪ সালের ১৬ জুন মৃত্যু বরণ করেন।
লেখকঃ সম্পাদক এস ডব্লিউ নিউজ ২৪ ডট কম ও সভাপতি প্রেসক্লাব পাইকগাছা।