বৃহস্পতিবার ● ১৪ মার্চ ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » ভবিষ্যৎ গড়তে শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে
ভবিষ্যৎ গড়তে শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে
প্রকাশ ঘোষ বিধান
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুরাই একদিন রাষ্ট্রনায়ক হবে। আগামীতে দেশকে শাসন করবে বা দেশের বড় কোন দায়িত্ব গ্রহণ করবে। পৃথিবীতে আজ যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করলো আগামীতে সে বড় ডাক্তার, বিজ্ঞানী বা বড় সাহিত্যিক হয়ে যাবে। শিশুরাই আগামীতে দেশের আদর্শ নাগরিক হবে। তবে এর জন্য দরকার শিশুদের সঠিক পরিচর্যা এবং তাদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার সুস্থ পরিবেশ। আর ছোটবেলা থেকেই আমরা যদি শিশুদের প্রতি সঠিকভাবে পরিচর্যা না করি তাহলে আমাদের দেশ ও জাতি ভবিষ্যদের মুখ থুবড়ে পড়বে। একটি জাতি উন্নতির শিখরে পৌছাঁতে পারবে না। তাই শিশুর ভবিষ্যৎ গড়তে আমাদের শিশুদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।
১৯৫৪ সাল থেকে জাতিসংঘ প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব শিশু দিবস পালন করে। বাংলাদেশে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মদিনেই শিশু দিবস পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি শিশুদের প্রতি শুরু থেকেই অনেক বেশি দয়াবান এবং সচেতন ব্যক্তি ছিলেন। ১৭ মার্চ ১৯২০ সালে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আমাদের এই দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে অনেক পরিশ্রম করে গেছেন এবং মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে কখনোই আপোষ করেননি। এ কারনে ১৭ মার্চ একসাথে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস পালিত হয়।
শিশু দিবসের তাৎপর্য অনেক গভীর এবং ব্যাপক। শিশু দিবসটি পালন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুদের সমস্যা গুলো খুঁজে বের করা এবং তাদের মৌলিক অধিকারগুলো আদায় নিশ্চিত করা। জাতিসংঘ থেকে ১৯৫৯ সালে একটি শিশু অধিকার সনদ প্রকাশ করে। এটি শিশু অধিকার সনদ ৯০ নামে পরিচিত। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে দেশের অধিকাংশ মানুষ এই শিশু দিবস সম্পর্কে অবগত নয়। সে জন্য শিশু দিবসটি এমন ভাবে পালন করতে হবে যাতে সবাই এর ব্যাপারে অবগত হয় এবং এই শিশু দিবসের তাৎপর্য বুঝতে পারে।
দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ২৫ শতাংশই হচ্ছে শিশু। দেশের ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুরা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে কাজ করছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, ৫টি খাতে ৩৮ হাজার আট শিশু কাজ করছে, যার ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশই ছেলে শিশু।সবচেয়ে বেশি কাজ করে অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে।
বিবিএস বলছে, বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ৪৩টি সেক্টরকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সেক্টরগুলোকে ফোকাস করে, শিশুশ্রম বিরাজমান রয়েছে এবং জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এ জরিপটি পরিচালনা করা হয়েছে।এই নির্বাচিত সেক্টরগুলো ১ মাছ, কাঁকড়া, শামুক/ঝিনুক সংক্ষরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ (শুটকি মাছ উৎপাদন) ২ পাদুকা উৎপাদন (চামড়ার তৈরি পাদুকা শিল্প) ৩ লোহা ও ইস্পাত ঢালাই (ওয়েন্ডিং কাজ বা গ্যাস বার্নার মেকানিকের কাজ) ৪ মোটর যানবাহনের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত (অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ) এবং ৫ ব্যক্তিগত এবং গৃহস্থালি সামগ্রীর মেরামত (অনানুষ্ঠানিক এবং স্থানীয় টেইলারিং এবং পোশাক সেক্টর)।
আইএলওর সহযোগিতায় বিবিএস বাংলাদেশে তার নিজস্ব প্যাটার্নে এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। জরিপের প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, ৪০ হাজার ৫২৫টি প্রতিষ্ঠান এবং ৩৮ হাজার ৮ জন ৫-১৭ বছর বয়সী শিশু উপরি-উক্ত সেক্টরগুলোতে কর্মরত। ঝুঁকিপূর্ণ সেক্টরে কাজে নিয়োজিত শিশুদের মধ্যে ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ ছেলে এবং ২ দশমিক ৫ শতাংশ মেয়ে শিশু। এই ৫টি সেক্টরে শ্রমজীবী মোট শিশুর সংখ্যা হলো যথাক্রমে শুটকি মাছ উৎপাদনে ৮৯৮, চামড়ার তৈরি পাদুকা তৈরিতে ৫,২৮১টি, ওয়েল্ডিং বা গ্যাস বার্নার ম্যাকানিকের কাজে ৪,০৯৯, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে ২৪,৯২৩ এবং অনানুষ্ঠানিক এবং স্থানীয় টেইলারিং বা পোশাক খাতে ২,৮০৫ জন।
৫টি ঝুঁকিপূর্ণ খাতের উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে শ্রমজীবী শিশুদের সবচেয়ে বড় অংশ নিয়োজিত রয়েছে অটোমোবাইল খাতে। পল্লী ও শহর বিবেচনায় এই খাতে কর্মরত শিশুর ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ পল্লী এবং ৬৪.৩% শহর এলাকায় বসবাস করে। এ জরিপের মাধ্যমে একটি শ্রমজীবী শিশু ঝুঁকিপূর্ণ সেক্টরসমূহে কাজ করার সময় কি কি ধরনের বিপজ্জনক কাজ করতে পারে তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। আনুমানিক ১৯.১% ছেলে এবং ৭.৭% মেয়ে শিশু ভারী বোঝা বহন, মালামাল টানার কাজে, অধিক ওপর বা ফ্লোর হতে অতি উচ্চতায় উঠে কাজ করে প্রায় ৮.১% ছেলে এবং ০.৩% মেয়ে শিশু।
বাংলাদেশে প্রায় ছয় কোটি শিশু ও কিশোর রয়েছে। জাতিসংঘ থেকে পাস হওয়া শিশুদের অধিকারগুলো নিয়ে কাজ করলেও গরিব দেশ তাদের অর্থনৈতিক কারণে সেই অধিকারগুলো এখনও বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হচ্ছে না। এমনকি তাদের যে মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সঠিক ও যথাযথভাবে পাচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশে নয় ভারত, নেপাল, মালেশিয়া শ্রীলঙ্কা বার্মা বিভিন্ন দেশেও এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে শিশু অধিকারগুলো কার্যকরী হয়নি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে দেশের দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং প্রচুর পরিমাণে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া। পৃথিবীর এক অংশের শিশুরা যে ধরনের অধিকার পাচ্ছে অন্য অংশের শিশুরা তার অধিকার পাচ্ছে না। বিশেষ করে আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশে শিশুরা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তারা ক্ষুধার সময় কোন ধরনের খাদ্য পাচ্ছে না এবং চিকিৎসা পাচ্ছে না।বিশ্বে প্রায় ১০০ কোটির মত রয়েছে শিশু এবং তার বেশিরভাগই অনেক অবহেলিত এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত। আর সারা বছর অপুষ্টিতে ভোগার ফলে প্রায় তিন লক্ষ শিশুর মত মৃত্যুবরণ করে।
শিশু আগামী দিনের দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। শিশুরাই আগামীতে দেশের আদর্শ নাগরিক হবে। তার জন্য শিশুদের সঠিক পরিচর্যা এবং তাদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাদেরকে ছোট থেকে পারিপার্শ্বিক আচার-আচরণ এবং সঠিক শিক্ষা দিয়ে ভালো মানুষ বানাতে হবে। শিশুদের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে সেগুলো সঠিকভাবে পালন করতে হবে। এ কারণে প্রত্যেক শিশুদের অভিভাবকদেরকে তাদের শিশুর প্রতি যথেষ্ট সচেতন থাকতে হবে।
লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট