বুধবার ● ১৭ জুলাই ২০২৪
প্রথম পাতা » কৃষি » পাইকগাছায় চিংড়ি ও মৎস্য চাষে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটেছে
পাইকগাছায় চিংড়ি ও মৎস্য চাষে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটেছে
খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় চিংড়ি ও মৎস্য চাষে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটেছে। আর দেশে নীরব রুপালি বিপ্লব ঘটেছে। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, রফতানি বাণিজ্যের প্রসার সর্বোপরি আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের অবদান অনস্বীকার্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে দেশে মৎস্য উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য সেক্টরের অবদান অসামান্য। আমাদের দেশজ উৎপাদনের ৩.৬৯ শতাংশ, মোট কৃষি আয়ের ২২.৬ শতাংশ এবং রপ্তানি আয়ের ৪ শতাংশের অধিক আসে মৎস্য খাত থেকে। দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দেয় মৎস্য খাত। আমাদের দেশে মোট বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ ৪ লাখ ১২ হাজার ৩৪১ হেক্টর। তার মধ্যে ২৬ হাজার হেক্টর পুকুর, ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর হাওর-বাঁওড় এবং ১ লাখ ৪১ হাজার ৩৫৩ হেক্টর চিংড়ি খামার।বিভিন্ন উপাত্ত থেকে জানা যায়, দেশের প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ বা ১১ শতাংশ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতে জীবিকা নির্বাহ করে। বছরে প্রায় ৬ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে এই সেক্টরে। নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুরসহ জলাধারের সংখ্যা হ্রাস পেলেও আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য উৎপাদন বিস্ময়করভাবে বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।
ইলিশ মাছ উৎপাদনে বিশ্বে ১ নম্বরে বাংলাদেশ, বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়,বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।মাছ উৎপাদনের পাশাপাশি রপ্তানিতেও এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। মাছ রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের উন্নয়নেও রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
উপকূলের লবণ পানির চিংড়ি ও মৎস্য চাষে বদলে গেছে পাইকগাছার প্রায় ৩ লাখ মানুষের জীবনমান। বর্তমানে এ উপজেলায় ১৭ হাজার ৮৫ হেক্টর জমিতে লবণ পানির চিংড়ি ও অন্যান্য মৎস্য চাষ হচ্ছে। মাছ চাষে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য বেশ কয়েকবার জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত হয়েছেন এ অঞ্চলের চাষিরা। ছোট-বড় ঘেরের সংখ্যা রয়েছে সাড়ে ৫ হাজার। প্রতিবছর উপজেলায় প্রায় ২৪ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি ও কাঁকড়াসহ অন্যান্য মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। উৎপাদিত মৎস্য স্থানীয় চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। এখানকার মৎস্য সম্পদ স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এখানকার প্রান্তিক মানুষ।
জানা গেছে, ৮০-এর দশকে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এ জনপদে লবণ পানির চিংড়ি চাষ শুরু হয়। চিংড়ি চাষ লাভজনক হওয়ায় এ চাষ ব্যবস্থা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা উপজেলায়। শুরুর দিকে চিংড়ি ঘেরগুলো বৃহৎ আয়তনের ছিল, যা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে এসেছে। এখন বেশিরভাগ জমির মালিকরা তাদের নিজেদের জমিতে বাঁধ দিয়ে নিজেরাই চিংড়িসহ অন্যান্য মৎস্য চাষ করছেন। ফলে এলাকার প্রায় প্রতিটি মানুষ চিংড়ি চাষ ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছেন। কেউ সরাসরি চাষের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, আবার অনেকে যৌথভাবে চাষ করছেন। কেউ কেউ তাদের জমি লিজ দিয়ে হারির টাকা নিয়ে অন্যান্য কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। অনেকেই আবার পোনা এবং অন্যান্য মৎস্য ক্রয়-বিক্রয় ও সরবরাহ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ৫ দশক আগে শুরু হওয়া চিংড়ি চাষ ব্যবস্থায় মানুষের জীবনমান পরিবর্তন হলেও চাষ ব্যবস্থাপনায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। এখনো অধিকাংশ চিংড়ি চাষিরা সনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করছেন।
পাইকগাছা উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, উপজেলায় বর্তমানে ১৭ হাজার ৮৫ হেক্টর জমিতে লবণ পানির চিংড়ি চাষ হচ্ছে। ছোট-বড় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ঘের রয়েছে। ৭৫ হেক্টরে ২২৫টি গলদা ঘের রয়েছে। পুকুর রয়েছে ২৯১ হেক্টরের ২ হাজার ৫৫৮টি। বাগদা-গলদা, টেংরা, পারশে ও ভেটকিসহ এখানকার মূল্যবান মৎস্য সম্পদের মধ্যে কাঁকড়া অন্যতম। এসব মৎস্য সম্পদের মধ্যে বাগদা-গলদা, কাঁকড়া ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চিংড়ি এবং সাদা মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। বাগদা-গলদা ছাড়া অন্যান্য মৎস্য আলাদাভাবে চাষাবাদ হয় না। সচরাচর চিংড়ি ঘেরের সঙ্গেই টেংরা, পারশে, ভেটকি ও কাঁকড়াসহ অন্যান্য মৎস্য উৎপাদন হয়ে থাকে। উপজেলা থেকে প্রতিবছর ৫ হাজার ৪৯০ মেট্রিক টন বাগদা চিংড়ি উৎপাদিত হয়। যার বাজার মূল্য প্রতিকেজি ৬শ’ থেকে ১২শ’ টাকা। হরিণা, চালি, চাকাসহ অন্যান্য চিংড়ি উৎপাদিত হয় ৬৭০ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য প্রতিকেজি ৬শ’ থেকে ৮শ’ টাকা। গলদা উৎপাদন হয় ৪২ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য প্রতিকেজি ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা। সাদা মাছ ১২ হাজার ২শ’ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য প্রতিকেজি ১৫০ থেকে ৮শ’ টাকা। কাঁকড়া উৎপাদন হয় ৩ হাজার ৩৫০ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য প্রতিকেজি ৩শ’ থেকে ২ হাজার টাকা। উন্মুক্ত নদী থেকে ৩৩০ মেট্রিক টন মৎস্য আহরণ হয়।
মাছের পোনা ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন জানান, উপজেলায় ৫টি হ্যাচারি, ৫০টি নার্সিং পয়েন্ট ও শতাধিক পোনা বিক্রয়ের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ক্ষুদ্র চিংড়ি চাষি ঘোষাল গ্রামের জামিলুর রহমান রানা বলেন, আমার নিজের ৮ বিঘা জমিতে চিংড়ি ঘের রয়েছে। যেখানে আমি ধান ও চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ চাষ করে থাকি। ধানের উৎপাদন একটু কম হলেও মাছের উৎপাদন ভালো হওয়ায় চিংড়ি ঘেরের আয় থেকে পরিবারসহ আমি সুন্দর জীবনযাপন করছি।
পাইগাছা উপজেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া রিপন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে চিংড়ি চাষ উপযোগী হলেও নানা সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চিংড়ি চাষিরা। বিশেষ করে মৌসুমের শুরুতেই পানি উত্তোলন করা নিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাষ শুরু করা যায় না। চাষিদের উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া, সরকারি খাল খনন করার মাধ্যমে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ও উন্নতমানের পোনা সরবরাহ করা গেলে চিংড়ির উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়তো এবং চাষিরা লাভবান হতেন।
উপজেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি মোস্তফা কামাল জাহাঙ্গীর বলেন, এখানকার উৎপাদিত চিংড়ি ও অন্যান্য মৎস্য সম্পদ স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। চিংড়ি ও মৎস্য খাত রক্ষা করার জন্য গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করার পাশাপাশি সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সৈকত মল্লিক বলেন, বর্তমানে উপজেলায় ১৭ হাজার ৮৫ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। প্রতিবছর অত্র উপজেলা থেকে প্রায় ২৪ হাজার মেট্রিক টন চিংড়িসহ অন্যান্য মৎস্য উৎপাদন হচ্ছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
উন্নত পদ্ধতি অনুসরণ ও চিংড়ি চাষের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা গেলে উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভাব। মৎস্য উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে চিংড়ি ও মৎস্য চাষিদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হয় বলে মৎস্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট এ কর্মকর্তা জানান। উপকূলীয় এ জনপদের চিংড়ি ও অন্যান্য মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে সরকার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন সবার এমনটাই প্রত্যাশা।