শুক্রবার ● ৪ অক্টোবর ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » ডাকের সেকাল ও একাল
ডাকের সেকাল ও একাল
প্রকাশ ঘোষ বিধান
ডাকবাক্স, ডাকঘর, ডাকপিয়ন বা ডাক হরকরা এ শব্দগুলো আজকের যুগে খুব প্রয়োজনীয় না হলেও একসময় মানুষের মন এসব নিয়ে পড়ে থাকতো। দিনের পর দিন অপেক্ষা করে থেকেছে ডাকপিয়নের জন্য। কখন চিঠি নিয়ে আসবে ডাকপিয়ন। এক সময় মানুষ এসব নিয়ে পড়ে থাকত। সে সময় চিঠিই ছিল মানুষের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। সেসব এখন স্মৃতি। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সবার হাতে রয়েছে বার্তাবাহক স্মার্টফোন। এখন আধুনিকতার আলোতে পুরাতন স্মৃতিতে ঠাঁই নিয়েছে। এতে ডাকবাক্স, পোস্ট অফিস, ডাকপিয়ন এসব যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোস্টমাস্টার এক অনন্য ছোটগল্প। তাঁর একটি প্রতীকী বা রূপক নাটকের নামও দিয়েছেন ডাকঘর। সুকান্ত ডাক হরকরাদের সংগ্রামী জীবন নিয়ে লিখেছেন কবিতা রানার। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এক নীতিবান ডাক বাহক ও তার বিপথগামী সন্তানকে নিয়ে ডাক হরকরা নামের গল্প লিখেছেন। রানারের হাতে বর্ষা বা বল্লম এখন আর দেখা যায়না, রাতের অন্ধকারে ঝুম - ঝুম ঘন্টার আওয়াজও আর পাওয়া যায়না, তবু রানার আজও আছে দেশের সর্বত্র।
সময়ের সাথে সাথে আমাদেরকে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রাস করেছে। হাতে লেখা চিঠির প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ই-মেল, হোয়াটসঅ্যাপেই সব কথা বলা হয়ে যায়। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও ডাকব্যবস্থার অন্য এক গুরুত্ব থেকেই গিয়েছে। ডাকে হয়তো চিঠি পাঠানো হয় না, কিন্তু প্রয়োজনীয় জিনিস এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠাতে গেলে ভরসাযোগ্য নিরাপদ ব্যবস্থা শতাব্দীপ্রাচীন এই ডাক। শতাব্দীপ্রাচীন এই ডাকব্যবস্থার কথা মাথায় রেখেই ৯ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব ডাক দিবস।
১৮৭৪ সালের এই দিনে সুইজারল্যান্ডের বের্ন শহরে বিশ্ব ডাক সংস্থার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে স্মরণ করে প্ৰতি বছর ৯ অক্টোবর গোটা বিশ্বজুড়ে পালন করা হয়। ৯ অক্টোবর প্রথম বিশ্ব ডাক দিবস ঘোষণা করা হয় ১৯৬৯ সালে জাপানের টোকিওতে ইউপিইউ কংগ্রেসে। ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য শ্রী আনন্দ মোহন নারুলা প্রস্তাবটি পেশ করেন। সেই থেকে ডাক পরিষেবার গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য সারা বিশ্বে বিশ্ব ডাক দিবস পালিত হয়ে আসছে । বিশ্ব ডাক সংস্থা চিঠি লিখে তথ্য আদান-প্রদান এবং যোগাযোগের মাধ্যমে ডাক বিভাগে বৈশ্বিক বিপ্লবের সূচনা করে। ডাক সেবার প্রচার এবং প্রসার এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য।
উপমহাদেশে প্রাচীনতম ডাক যোগাযোগ সম্পর্কিত তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে বৈদিক গ্রন্থ অথর্ববেদে। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে নল-দময়ন্তীর হাঁস, রামায়নে হনুমান, মহাভারতে বিদুর এবং আনারকলীর হরিণ প্রভৃতি প্রাণীকে দূতিয়ালীর কাজে ব্যবহার হতে দেখা যায়। বাংলা ডাক কথাটির শব্দার্থ আহবান করা অথবা মনোযোগ আকর্ষণ করা। এ শব্দ থেকে ডাকব্যবস্থা, ডাকঘর, ডাকহরকরা এবং ডাকমাশুল শব্দগুলির উদ্ভব হয়েছে। এ অঞ্চলে প্রচীনকাল থেকেই সংবাদ আদান-প্রদান ব্যবস্থা চালু ছিল। বিভিন্ন সাহিত্যসূত্র, লোকগাথা ও ছড়া-কবিতায় দেখা যায় যে আদিকালে একস্থান থেকে অন্যস্থানে আপনজনের নিকট খবরাদি প্রেরণের জন্য দূত এবং কবুতর ব্যবহার করা হতো। প্রাচীনকালে দূতের সামাজিক অবস্থান উচ্চে ছিল।
বার্তা প্রেরণের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রথম আসে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে ৩২১ থেকে ২৯৭ খ্রীষ্ট পূর্ব্বাদে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাঁর বিরাট সাম্রাজ্যকে শাসন ব্যবস্থার সুবিধার জন্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন। তিনিই প্রথম প্রাদেশিক রাজধানীর সাথে সাম্রাজ্যের মূল রাজধানীর বার্তা বিনিময়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনিই প্রথম শুরু করেন পায়রা মারফত বার্তা আদান প্রদানের ব্যবস্থা। শুরু হয় মানুষ ছাড়া কোনো মাধ্যমের দ্বারা এক জায়গা থেকে দূরবর্তী কোনো জায়গায় বার্তা প্রেরণ। এই ব্যবস্থা এই ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত থাকে। পায়রা ছাড়াও ঈগল বা অন্যান্য অনেক ধরনের পাখির ব্যবহার দেখা যায় ইতিহাসে, যাদের দিয়ে বার্তা পাঠানো হতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। এই পদ্ধতিতে বার্তা প্রেরণ মূলতঃ যুদ্ধক্ষেত্রের বা অন্য কোনো গোপন খবর পাঠানোর জন্য কাজে লাগানো হতো। সাধারণ মানুষের কোনো খবর পাঠানোর ব্যবস্থা তখন ছিলনা। পায়রা ছাড়াও ঈগল বা অন্যান্য অনেক ধরনের পাখির ব্যবহার দেখা যায় ইতিহাসে, যাদের দিয়ে বার্তা পাঠানো হতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। এই পদ্ধতিতে বার্তা প্রেরণ মূলতঃ যুদ্ধক্ষেত্রের বা অন্য কোনো গোপন খবর পাঠানোর জন্য কাজে লাগানো হতো। সাধারণ মানুষের কোনো খবর পাঠানোর ব্যবস্থা তখন ছিলনা।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমল শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ অব্দে আর তা শেষ হয় ২৯৮ অব্দে। তবু তার সময়ে ভারতবর্ষে কুরিয়ার শুরু হওয়ার উল্লেখটি সম্ভবত সত্যি। কারণ মহাস্থানগড়ের খননে প্রাপ্ত ব্রাহ্মীলিপি ফলক থেকে জানা যায়, চন্দ্রগুপ্ত স্থানীয় সামন্তরাজাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রজাদের যেনো রাজভাণ্ডার থেকে সম্পদ দেওয়া হয়। নির্দেশনাটি ক্যুরিয়ার মারফতই পাঠিয়েছিলেন বলে ধারণা করা যায়। ক্যুরিয়ার শব্দের বাংলা হলো দূত, ধাবক বা সংবাদবাহক।
বহু শতাব্দী ধরে ডাক ব্যবস্থা চালু আছে। মানুষ একে অপরকে চিঠি পাঠায়। এগুলো পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে বিশেষ বার্তাবাহকদের দ্বারা বিতরণ করা হতো। ৬০২-৬৮০ খ্রিস্টাব্দে খলিফা মুয়াবিয়া দাপ্তরিক ডাক যোগাযোগের জন্য দেওয়ান-ই-বারইদ বা ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন কাবুল থেকে দিল্লি হয়ে ৬টি মেইল রুটে ৯৩০টি পোস্টাল স্টেশন ছিল। ১১৮৬-১২০৬ খ্রিস্টাব্দে ঘুরি সাম্রাজ্য আমলে উটের মাধ্যমে সংবাদ আদান প্রদানের ব্যবস্থা তখন শুরু হয়। ১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লির প্রথম সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক-এর শাসনামলে ডাক ব্যবস্থার ক্রমোন্নতির একটা ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি দিল্লি থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত ঘোড়ার ডাক ব্যবস্থা চালু করেন। সুলতান আলাউদ্দিন খলজী ১২৯৬ সালে ঘোড়ায় চড়া এবং পায়ে হাঁটা ডাকবাহকের সাহায্যে তথ্য পরিবহণের ব্যবস্থা ও ডাকচৌকি স্থাপন করেন। ১৬০০ সাল থেকে প্রথম জাতীয় ডাক ব্যবস্থা অনেক দেশে উত্থিত হতে শুরু করে।সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসন আমলে ১৬১০ সাল থেকে বাংলার রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দিল্লির ডাক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ডাক গ্রহণ ও প্রেরণের জন্য ডাকচৌকির দারোগা বা সুপারিনন্টেন্ডেন্ট নিয়োগ করা হয়। ১৭৬৬ সালে রবার্ট ক্লাইভ প্রথমবারের মতো ডাক ব্যবস্থার সংস্কার করেন। কলকাতায় একজন পোস্টমাস্টার নিয়োগ দেয়া হয়, কলকাতার সঙ্গে ৬টি ডাক যোগাযোগ কেন্দ্রের সংযোগ স্থাপন করা হয়, তবে প্রধান সংযোগ ছিল ঢাকা ও পাটনার সঙ্গে। এই ব্যবস্থাকে বলা হতো ক্লাইভের ডাক। ওয়ারেন হেস্টিংস্-এর সময় ১৭৭৪ সালের ১৭ মার্চ তারিখে কলকাতায় জিপিও বা জেনারেল পোস্ট অফিস স্থাপন করা হয়। ১৭৯১ সালে ডাক বহনের মাশুল পুনর্বিন্যাস করা হয় এবং কলকাতা থেকে ঢাকা তিন আনা, চট্টগ্রাম পর্যন্ত ছয় আনা মাশুল ধার্য করা হয়। ১৭৯৩ সালে এক বিধি জারির মাধ্যমে ডাক ব্যবস্থা আরও সংগঠিত ও নিয়মতান্ত্রিক রূপ লাভ করে। এ ব্যবস্থায় স্থানীয় ডাক যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব বর্তায় জমিদারদের ওপর। এ সময়ে ব্যবসায়ীরা তাদের নিজস্ব ডাক ব্যবস্থাও চালুর করে। এ ডাকব্যবস্থাকে বলা হতো মহাজনি ডাক। সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ী এবং জমিদাররা এর সুযোগ ভোগ করতেন।
১৮৫৪ সালে সমন্বিত আধুনিক ডাকব্যবস্থার অধীনে দূরত্বভিত্তিক চিঠি পাঠানোর মাশুলের পরিবর্তে ওজনভিত্তিক মাশুল আদায়ের ব্যবস্থা চালু করা হয়। এ সময়ে প্রথম সর্বভারতীয় ডাকটিকিট প্রবর্তন করা হয়। দ্রুত ডাক পরিবহণের মাধ্যম হিসাবে রেল পরিবহণ ব্যবস্থার সহায়তা গ্রহণ করা হয় এবং রেলওয়ে মেইল সার্ভিস চালু হয়। এ সময় প্রথম আধা আনা মূল্যের লালচে কমলা এবং এক আনা মূল্যের উজ্জ্বল নীল রঙের ডাকটিকিট চালু হয়। ১৮৮০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে নিয়মিত রেল মেইল সার্ভিস চালু হয়।১৮৬৬ সালে পাস করা পোস্ট অফিস আইন ১৮৬৭ থেকে কার্যকর হয়। ১৮৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় সদর দপ্তর স্থাপন করে পোস্ট অফিসের পূর্বাঞ্চলীয় শাখা চালু করা হয় এবং চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে বিলি বা ডেলিভারি অফিস স্থাপন করা হয়। ১৮৭৯ সালে সর্বপ্রথম এক পয়সা মূল্যের পোস্টকার্ড চালু করা হয় এবং তৎকালীন বিশ্বে এটাই ছিল ডাক বহনের ন্যূনতম হার। ১৮৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে এক আনা মূল্যের এমবস্ড খাম চালু করা হয়। ১৮৭৭ সালের ১ আগস্ট থেকে রেজিস্টার ডাক এবং একই সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ভ্যাল্যু পেয়েবল ডাক ও ১৮৭৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বীমাকৃত ডাক চালু করা হয়। ১৮৫৬-৫৭ সালে প্রথম চিঠি ফেলার বাক্স বা লেটার বক্স চালু হয়।
১৮৮০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ভারতের সকল ডাকঘরে মানিঅর্ডার ব্যবস্থা চালু হয়। ১৮৮৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে অফিসের মাধ্যমে টেলিগ্রাফ সার্ভিস চালু করা হয়।১৯০৫ সালে বাংলাকে বিভক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসামের সমন্বয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হয়। ১৯০৭ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম ডাক সার্কেল গঠিত হয় এবং তৎকালীন সার্কেলের যেসব অঞ্চল এই নতুন সার্কেলের এলাকাভুক্ত ছিল ঐসব অঞ্চলই নতুন সার্কেলের অর্ন্তভুক্ত হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে এই নতুন সার্কেল আবার আগের পূর্ববঙ্গ ও আসাম সার্কেলের সঙ্গে একীভৃত করা হয়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফিল্ড পোস্ট অফিস স্থাপন করা হয় সেনাবাহিনীর কার্যক্রমে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে। ১৯৩৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা-কলকাতার মধ্যে বিমানে ডাক পরিবহণ শুরু হয়।১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হলে ডাক বিভাগ ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। চট্টগ্রামে অভ্যন্তরীণ ডাক সেন্সর স্টেশন স্থাপন এবং পরে ১৯৪৩ সালের মার্চ মাসে ময়মনসিংহ, ঢাকা ও চাঁদপুরে সেন্সর সাবস্টেশন স্থাপন করা হয়। ১৯৪২ সালের মে মাসে পূর্ববাংলার প্রথম ফিল্ড পোস্ট অফিস স্থাপিত হয় যশোর জেলার ঝিকরগাছায় সেনাবাহিনীর সহায়তার জন্যে। পরে আসাম, আরাকান ও বার্মায় যুদ্ধরত সেনা সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার লক্ষ্যে আরও অনেক ফিল্ড পোস্ট অফিস স্থাপন করা হয়। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষে ফিল্ড পোস্ট অফিসগুলি গুটিয়ে ফেলে আরও উন্নত স্থানে অবস্থিত ডাকঘরের সঙ্গে একীভৃত করা হয়।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত করা হয়। এতে বাংলাও বিভক্ত হয়ে যায় এবং অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকা নিয়ে পূর্ববাংলা প্রদেশ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ৯ জুলাই তারিখে পাকিস্তানের নিজস্ব ডাকটিকিট এবং একই সালের ১৪ আগস্ট নিয়মিত ডাকটিকিট সিরিজ চালু করা হয়। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ডাক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। জেলা শহরগুলিতে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ সাব ডাকঘরগুলির উন্নয়ন করে প্রধান ডাকঘরে রূপান্তর করা হয়। ১৯৫৬ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ডাকটিকিট ও অন্যান্য কাগজপত্র বাংলা হরফে মুদ্রিত হয়।১৯৫৯ সালে ঢাকা খুলনা এবং চট্টগ্রামে নতুন জেনারেল ডাকঘর স্থাপন করা হয়। ১৯৬১ সালে মেট্রিক পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে টাকা-আনা-পাইয়ের পরিবর্তে মুদ্রার নতুন একক নির্ধারণ করা হয়। ১৯৬৩ সালে ঢাকা জেনারেল পোস্ট অফিসের জন্য নতুন কমপ্লেক্স স্থাপন করা হয়। ১৯৬৯ সালে কমলাপুর রেলস্টেশন স্থাপিত হলে রেলওয়ে মেইল সার্ভিস সেখানে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭০ সাল থেকে ডাক ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় ৫০টি ফিল্ড পোস্ট অফিস চালুর মাধ্যমে এবং মুক্তিবাহিনীর সার্বিক বা আংশিক পরিচালনায় ডাক ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর মুজিবনগর সরকারের ফিল্ড পোস্ট অফিসগুলি বন্ধ করে দেশের স্থায়ী ডাকব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত করা হয়।
১৮৪০ সালে প্রথম ডাকটিকিট ব্যবহার হয় ব্রিটেনে। এর একযুগ পরে ১৮৫২ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ডাকটিকিটের প্রথম ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই ভারতীয় নাগরিক বিমান মল্লিকের ডিজাইন করা আটটি ডাকটিকিট কলকাতায় বাংলাদেশ মিশন ও লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। কূটনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে এই উদ্যোগ গ্রহণ করে মুজিবনগর সরকার। দেশে ডাকটিকিট সংগ্রাহকদের উৎসাহিত করার জন্য ১৯৭২ সালেই ডাকবিভাগের আনুকূল্যে ডাকটিকিট সংগ্রাহকদের একত্রিত করে একটি ডাকটিকিট সংগ্রহক সমিতি গঠন করা হয়। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ডাকটিকিট ভারতের নাসিক, ইংল্যন্ডের ব্র্যাডবেরি উইলকিনসন, হ্যারিসন অ্যান্ড সন্স, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশার এন্ড কোংসহ স্পেন, অস্ট্রিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন সিকিউরিটি প্রেস থেকে ছাপিয়ে আনা হতো। ১৯৮৯ সালের ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের নিজস্ব নিরাপত্তা ছাপাখানা স্থাপনের পর থেকে দেশের সকল ডাকটিকিট ও স্টেশনারি অর্থাৎ খাম, পোস্টকার্ড প্রভৃতি দ্রব্য এখান থেকেই ছাপানো হয়। দেশের ১০ হাজার ডাকঘরে প্রায় ৪৫ হাজার কর্মী ডাক সেবায় নিয়োজিত। দেশে ৮ হাজার ৫০০ ডাকঘরকে রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় তৃণমূল জনগোষ্ঠী সরকারের ২০০ ডিজিটাল সেবা পাচ্ছে। এতে উৎপাদনমুখী কর্মকান্ডের ডিজিটাইজেশনের ভিত তৈরি হয়েছে।
এখনো বিশ্বব্যাপী চিঠি লিখন প্রতিযোগিতা হয়। পত্রমিতালি নব্বইয়ের দশকের একটি জনপ্রিয় যোগাযোগ প্রক্রিয়া ছিল। ডাকটিকিট জমানো এখনো অনেকের কাছে মূল্যবান শখ। শত শত স্মৃতি জমা করেছে ডাকঘর, রানার, পোস্টমাস্টার, চিঠি, খাম বা পোস্টকার্ড নিয়ে। পাল্টে যাওয়া সমাজব্যবস্থাতেও ডাক ব্যবস্থার গুরুত্ব অনেক। একটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির প্রশ্নে ডাক ব্যবস্থার অবদান কোনও ভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট