রবিবার ● ৬ অক্টোবর ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » দুর্গা পুজোয় নবপত্রিকার তাৎপর্য
দুর্গা পুজোয় নবপত্রিকার তাৎপর্য
দেবী দুর্গার পুজোর সঙ্গেই ওতপ্রোত জড়িয়ে নবপত্রিকা। নবপত্রিকার পুজো আসলে ইঙ্গিত দেয় মানুষের উৎসব পালন এবং ধর্মাচরণের বহু প্রাচীন রীতির। তাই দুর্গাপুজোর যেমন মাহাত্ম্য, তেমনই স্বতন্ত্র তাৎপর্য আছে নবপত্রিকার পুজোরও। নবপত্রিকা বাংলার দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। নবপত্রিকা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নটি গাছের পাতা। তবে বাস্তবে নবপত্রিকা নটি পাতা নয়, নটি উদ্ভিদ। এগুলি হল - কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (দাড়িম), অশোক, মান ও ধান। একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেল-সহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে সপরিবার প্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পুজো করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম কলাবউ।
দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে। বেলগাছের নিচে দেবী দুর্গার বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের পর আসে মহাসপ্তমী। বোধন মানে দেবীকে ঘুম থেকে জাগানো। শাস্ত্রমতে, আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত দেবদেবীদের ঘুমানোর সময়। ঘুম ভাঙিয়ে দেবীকে মাঝপথে তোলা হয়, তাই অকালবোধন। সেই জাগরণ বা বোধনের পর ঢাকঢোল কাঁসরঘণ্টা বাজিয়ে সকালেই দেবীপূজার শুরু। এই সূচনাকে বলে নবপত্রিকা প্রবেশ। নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এর পর বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা প্রতিমাস্থ দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় হল, নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে পত্রিকার সম্মুখে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পুজো করা হয়। নবপত্রিকার ৯টি উদ্ভিদ আসলে দুর্গার ৯টি বিশেষ রূপের প্রতীক রূপে কল্পিত হয়।
মহাসপ্তমীর দিন সকালে কাছের কোনো নদী বা জলাশয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পুরোহিত বা পরিবারের জ্যেষ্ঠ কাঁধে করে নবপত্রিকা নিয়ে যান নদীতে। তার পেছনে থাকে ঢাক বাদকের দল। নারীদের হাতে থাকে শঙ্খ এবং উলুধ্বনি। শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী, মন্ত্রোচ্চারণ করে নবপত্রিকা নিয়ে ব্যক্তিটি জলাশয়ে ডুব দেন। এরপর নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয়। তাতে দেওয়া হয় সিঁদুরের টিপ। তারপর পূজামণ্ডপে নিয়ে এসে নবপত্রিকাকে দুর্গা প্রতিমার ডান দিকে অর্থাৎ গণেশের পরই একটি কাঠের সিংহাসনে স্থাপন করা হয়। পূজো মণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানিকতার সূচনা হয়। এমনকি, পূজার বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা, দুর্গা ও বাকী প্রতিমার সঙ্গে পূজিত হতে থাকে।
শ্বেত অপরাজিতার লতা ও হলুদ রঙের সুতোয় বাঁধা নয়টা গাছ কলা, ডালিম, ওল কচু, জয়ন্তী, অশোক, হলুদ, বেল, ধান, মানকচু। এই নয়টা গাছ, লতাপাতা বাংলার জলে–জঙ্গলে অক্লেশে হয়ে থাকে। দুর্গাপ্রতিমার ডান পাশে নবপত্রিকার এই কলাগাছ স্বাভাবিকভাবে নুইয়ে পড়ে। ফলে বাঙালি একে গণেশের বউ বা কলাবউ বলে। আদতে গণেশের সঙ্গে কলাবউয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। এই অযত্নলালিত উদ্ভিদগুলো সবই দুর্গারই রূপ। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় দেবীর অধিবাস, বোধনের পাশাপাশি নবপত্রিকারূপী দুর্গাকে আবাহন করতে হয়। প্রতিটি গাছেই দেবীর অধিষ্ঠান কলায় ব্রহ্মাণী, কচুতে কালী, হলুদগাছে দুর্গা, জয়ন্তীতে কার্তিকী, বেলে শিব, ডালিমে রক্তদন্তিকা, অশোকে শোকরহিতা, মানকচুতে চামুণ্ডা ও ধানে লক্ষ্মী।
এই নয় দেবী একত্রে নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা নামে নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ মন্ত্রে পূজিতা হন। গবেষকদের মতে, নবপত্রিকার পুজো প্রকৃতপক্ষে শস্যদেবীর পুজো। এই শস্য-মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ, সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপুজোর ভিতরে এখনও সেই আদিমাতা পৃথিবীর পুজো অনেকখানি মিশে রয়েছে।
নবপত্রিকার প্রধান গাছ হল কলাগাছ, যা ফার্টিলিটির প্রতীক। আবার কচু আশ্বিনের প্রথমে হয়। বাঙালির পেট ভরায়। আবার একই ধরনের আর এক আনাজ মানকচু। শরতের রোদ্দুর পেলে এটাও খুব সুস্বাদু হয়। ফলের মধ্য আছে বেল ও দাড়িম্ব অর্থাৎ ডালিম। বেলপাতা শিব এবং পার্বতীর প্রিয় এবং ওষুধি গুণও আছে। ডালিম আশ্বিন মাস থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত ভালো ফলে। হিমোগ্লোবিন কমে গেলে বা শরীর দুর্বল হলে ডালিম দারুণ কাজ করে। জয়ন্তী ও অশোক গাছদুটি আয়ুর্বেদের মহৌষধের কাজ করে। আবার জয়ন্তী দুর্গার একটি নাম। এর বীজ স্ত্রীরোগ নিরাময়ের কাজে লাগে। এরও ফলনও হয় আশ্বিনের শেষে। এছাড়া আছে হলুদ। কাঁচা হলুদ থেকে পাকা হলুদ শরীরের পক্ষে যেমন ভাল, তেমন বহু পূজা উপাচারে ব্যবহৃত হয়। এর থেকেই বোঝা যায় এই সময়ে ফুলফলে ভরে এমন ফলদায়িনী বৃক্ষের পাতার সমন্বয় হল নবপত্রিকা। আদতে শস্যের দেবী এবং মানুষের উপকারী গাছ। যা বাংলার মানুষদের অতিসাধারণ খাদ্য।
লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট