শিরোনাম:
পাইকগাছা, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

SW News24
মঙ্গলবার ● ১২ নভেম্বর ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সাংবাদিকতায় বিবেকের তাগিদ ; সংকট ও প্রেক্ষাপট
প্রথম পাতা » মুক্তমত » সাংবাদিকতায় বিবেকের তাগিদ ; সংকট ও প্রেক্ষাপট
৩০ বার পঠিত
মঙ্গলবার ● ১২ নভেম্বর ২০২৪
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

সাংবাদিকতায় বিবেকের তাগিদ ; সংকট ও প্রেক্ষাপট

 ---   প্রকাশ ঘোষ বিধান

সাংবাদিকতার মান, নিতি নৈতিকতা এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার শেষ নেই। এখন সংবাদ সমাজের সব থেকে গুরুত্ব বিষয়। তাই সবাই চায় নিরেট খবর। আর পাঠক করে তার নিরীক্ষণ। সাংবাদিকতার মানদণ্ড নির্ভর করে পত্র -পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পাঠকের  বিশ্লেষণমূলক পরিক্ষায়। সাংবাদিকতার প্রকৃত পরিচয় এবং মর্যাদা নির্ভর করে একজন সাংবাদিকের সৎ কাজ, নির্ভীকতা ও দায়বদ্ধতার উপর। কেবলমাত্র একটি পরিচয়পত্র নয় বরং সমাজের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সত্যের প্রতি অঙ্গীকারই তাদের প্রকৃত মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে। তাই সত্যিকার অর্থে সাংবাদিক হতে হলে নৈতিকতার সাথে তাদের নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করতে হয়।

সাংবাদিকতা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক আধুনিক পেশা। সাংবাদিকতার মূল কেন্দ্র বিন্দু হচ্ছে মান, নিতি ও নৈতিকতা। সাংবাদিকতার মূল শক্তি হলো সত্য এবং নির্ভীক মনোভাব। পত্রিকার প্রচার সংখ্যা নয় বরং সংবাদ ও লেখার মানই আসল। আজকের দিনে সাংবাদিকতার নামে অনেকেই কেবল একটি কার্ড হাতে নিয়ে নিজেকে সাংবাদিক দাবি করেন। এই কার্ডটি কেবল একটি পরিচয়ের বাহক যা তাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি দিতে পারে। কিন্তু এটি সাংবাদিকতার আসল গুণাবলি ও মূল্যবোধের মাপকাঠি নয়। প্রকৃত সাংবাদিকের পরিচয় নির্ভর করে তার কলমের শক্তির উপর। প্রকৃত সাংবাদিকতার পরিচয় হলো তার লেখনীর গভীরতা, সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা এবং সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহসিকতা।

সাংবাদিকতা শুধুমাত্র একটি পেশা নয়, এটি বিবেকে দ্বারা পরিচালিত দায়িত্ব। কিন্তু আজকের দিনে সংবাদপত্রে সাংবাদিকতার নামে কতিপয় নামধারী সাংবাদিকের আনাগোনা, যাদের কাছে সাংবাদিকতা শুধুমাত্র এক ধরনের কার্ডধারি পরিচয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা পড়াশোনা ও গবেষণার দিকে মনোযোগ দেন না, ফলে তাদের লেখার গভীরতা ও ধারাবাহিকতায় অভাব দেখা যায়। সাংবাদিকতা কখনোই মূর্খজনের পেশা নয়।  প্রকৃত সাংবাদিক হতে হলে এবং কলমের শক্তি বাড়াতে হলে পড়াশোনা অপরিহার্য।

বর্তমান সাংবাদিকতার মালিকানা চলে গেছে এক শ্রেণীর পয়সাওয়ালাদের হাতে, যারা কেবল নিজের স্বার্থেই কাজ করছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ দালালি ও তোষামোদিকে পেশার অংশে পরিণত করেছেন। সংবাদপত্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য জনগণের সঠিক খবর পৌঁছে দেওয়া, কিন্তু পেশাদারিত্ব হারিয়ে  সংবাদপত্রে মুক্ত সাংবাদিকতার জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

সাংবাদিকতার কাজ হলো সমাজের বিভিন্ন স্তরের সঠিক চিত্র তুলে ধরা এবং সত্যকে প্রকাশ্যে আনা। একজন প্রকৃত সাংবাদিকের কলমই প্রমাণ করে, তিনি আদতে আসল নাকি নামধারী সাংবাদিক। কলমের ধারায় তার সততা, নিরপেক্ষতা, এবং দৃঢ় প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত হয়। কোনো কার্ড বা বাহ্যিক পরিচয়ের মাধ্যমে এই গুণাবলি অর্জন করা সম্ভব নয়। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, কিছু লোক কেবল সংবাদপত্রের পরিচয়পত্র বা কার্ড ব্যবহার করে নিজেদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য এই পেশায় অবস্থান নিয়েছেন। এরা নিজেদের পরিচয় দিতে পারেন সাংবাদিক নামে, কিন্তু এদের কলমে নেই সঠিক সংবাদের জন্য সমাজের দায়বদ্ধতা কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস। এমনকি, অনেক সময় এরা বিভিন্ন স্বার্থপরায়ণ গোষ্ঠীর স্বার্থে দালালি বা তোষামোদির কাজ করেন, যা প্রকৃত সাংবাদিকতার মূল্যবোধকে অবমাননা করে।

প্রকৃত সাংবাদিকের পরিচয় বহন করে তার কাজের মান থেকে। তার লেখনীর মাধ্যমে সমাজ, সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংকটের কথা উঠে আসে। একজন প্রকৃত সাংবাদিক নিজেকে শুধু সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশের সঙ্গে সীমাবদ্ধ রাখেন না; বরং সমাজের প্রকৃত সমস্যা ও জনগণের দাবির পক্ষে দাঁড়িয়ে লেখেন। তার কাজের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে ন্যায়, সত্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।

সাংবাদিকদের সব সময় পাঠকের কাঠগড়ায় দাড়াতে হয়। প্রকাশিত সংবাদ ও সাংবাদিকের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন পাঠক। তাই ভালো সাংবাদিক হতে হলে প্রয়োজন পড়াশোনা ও গবেষণার। কারণ একজন প্রকৃত সাংবাদিক হতে হলে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তথ্য ও প্রযুক্তির সাথে প্রতিনিয়ত নিজেকে শাণিত করতে হয়। সাংবাদিকতা করতে হলে পেশাদারিত্ব এবং নৈতিকতার ভিত্তিতে কাজ করতে হয়। কলমের ধারাই প্রকৃত সাংবাদিকের মর্যাদা নির্ধারণ করে। এই জন্য কার্ডধারী নয়, কলমধারী সাংবাদিকই সমাজের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারেন। তার কলমই তার আসল পরিচয় এবং এই পরিচয়ের ভিত্তিতেই তিনি সত্যিকারের সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। সাংবাদিকতায় দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হয়। তাদের কলম হয়ে ওঠে সততার প্রতীক। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার সাহসিকতা কেবল প্রকৃত সাংবাদিকদের থাকে। সততা ছাড়া কোনো সাংবাদিক বহু মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে না।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শব্দটি খুব জটিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ এবং আরও কয়েক অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে এই স্বাধীনতা ভোগ করা যাবে কতিপয় আইনি শর্তসাপেক্ষে। অর্থাৎ কোনো স্বাধীনতাই নিরঙ্কুশ নয়, এমনকি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও। রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব যদি ভিন্নমত ধারণ করার মতো উদারতা না দেখায়, তা হলে সেখানেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নানাভাবে বিঘ্নিত হয়। তৈরি হয় নানামুখী সংকট।

পৃথিবীতে বিভিন্ন পেশার মানুষেরা সাংবাদিকতা করে বিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক হয়েছে। যাঁরা মূলত অন্য পেশায় কাজ করলেও সাংবাদিকতা পেশায় এসে প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে এডগার স্নো মার্কিন সাংবাদিক এবং লেখক, মার্থা গেলহর্ন, এলি উইজেল হলোকাস্ট থেকে বেঁচে আসা এই নোবেলজয়ী সাংবাদিক ও লেখক, নেলসন এলগ্রেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক, এ. জে. লিব্লিং এই মার্কিন সাংবাদিক, জ্যাক লন্ডন মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক। তারা সাধারণ পেশা থেকে সাংবাদিকতায় আসার পর তাদের স্বকীয়তার মাধ্যমে সাংবাদিকতায় অবদান রেখেছেন এবং তাঁদের লেখা আজও প্রভাব ফেলছে। বিশ্বের সাংবাদিকতার ইতিহাসে এসব ব্যক্তিরা খুব সাধারণ পেশা বা সংগ্রামী জীবনের মধ্য দিয়ে উঠে এসে সাংবাদিকতায় অবদান রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই একসময় অর্থের অভাবে নানা রকম সাধারণ কাজ করেছেন।

নির্ভীকতা, সত্য বলা ও লেখার সাহসই একজন সাংবাদিকের প্রকৃত পরিচয়। কোনো স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর চাপ বা রাজনৈতিক প্রভাব কলমের স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে দেওয়া উচিত নয়। ব্যক্তিগত লোভ ও লাভের জন্য এই পেশাকে যারা ব্যবহার করে তারা সাংবাদিকতার মূল স্রোতকে বিপথে চালিত করে। একজন ভালো সাংবাদিকের লেখার গুণমান এবং ভাবের গভীরতা তার জ্ঞানের ভিত্তিতেই নির্ভর করে। কাজের ক্ষেত্রে সমসাময়িক বিষয়গুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা জরুরি। পেশাগত নৈতিকতা বজায় রাখাই একটি দায়িত্বশীল সাংবাদিকের কাজ। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার জন্য নৈতিকতা এবং পেশাদারিত্বের মান বজায় রাখা অপরিহার্য।

সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের বিভিন্ন স্তরের বাস্তবতা তুলে ধরা। একটি সংবাদপত্র বা সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো তার পাঠকদের আস্থা। এই আস্থা অর্জন করতে হলে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে হবে, যাতে পাঠকের মনের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন হয়। আজকের পৃথিবীতে সাংবাদিকতা নানান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রকৃত সাংবাদিকদের উচিত এই চ্যালেঞ্জগুলোকে জয় করে সত্যের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করা। সাংবাদিকতায় সংকট বা চ্যালেঞ্জ থাকবে, তবে সাহসী ও ভালো সাংবাদিকদের হাত ধরেই সাংবাদিকতা এগিয়ে যাবে। সাংবাদিকতা যেন আলোর পথে থাকে, কলমের ছোয়ায় আধার যেন কেটে যায়। সমাজের পরিবর্তনে সাংবাদিকতা একটি শক্তিশালী প্লাটর্ফ্ম হয়ে গড়ে উঠুক।

লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ