শিরোনাম:
পাইকগাছা, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

SW News24
শুক্রবার ● ২০ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রথম পাতা » মুক্তমত » আমাদের পাখি
প্রথম পাতা » মুক্তমত » আমাদের পাখি
৩৫ বার পঠিত
শুক্রবার ● ২০ ডিসেম্বর ২০২৪
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

আমাদের পাখি

 ---   প্রকাশ ঘোষ বিধান

ধানের দেশ, গানের দেশ, পাখির দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অপরূপ প্রকৃতির এক অপূর্ব উপহার পাখি। পাখির রূপে মুগ্ধ হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। এ দেশের মানুষ পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে আবার পাখির ডাকে জাগে। বিভিন্ন ঋতুতে বাংলাদেশে নানা রকম পাখি দেখা যায়। পাখিদের কোলাহল, কলরব, ডানা মেলে অবাধ বিচরণে সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রং-বেরঙের নানা প্রজাতির পাখির সৌন্দর্য দৃষ্টি কাড়ে মানুষের। কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে পাখির অনেক প্রজাতি।

পাখি এভিস শ্রেণীর উষ্ণরক্তবিশিষ্ট, দেহ পালকে আবৃত এবং অগ্রপদ ডানায় রূপান্তরিত মেরুদন্ডী প্রাণী। এদের মস্তিষ্ক অপেক্ষাকৃত বড়, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও শ্রবণশক্তি প্রখর, কিন্তু ঘ্রাণশক্তি কম। ভারী চোয়াল ও দাঁতের পরিবর্তে শক্ত চঞ্চু এবং ফাঁপা হাড় ও অন্যান্য অংশে বায়ুথলী থাকায় পাখির দেহের ওজন কম। প্রায় ১৫ কোটি বছর আগে জুরাসিক সময়ে পাখিদের উৎপত্তি। পাখি পালক ও পাখাবিশিষ্ট দ্বিপদী মেরুদন্ডী প্রাণী। এদের হৃৎপিন্ডের প্রকোষ্ঠ চারটি এবং এরা দন্তহীন  প্রাণী। এদের পরিপাক ও রেচন প্রক্রিয়া তাদের সহজভাবে ওড়ার জন্য অনুকূল এবং অন্য সব প্রাণীদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

পৃথিবীতে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত জীবাশ্ম নির্দেশ থেকে জানা যায় যে, প্রাথমিক পাখিদের আবির্ভাব হয়েছিল জুরাসিক যুগে শেষে, প্রায় ১৬ কোটি বছর আগে। কিন্তু আসল পাখিদের বিবর্তন ঘটেছিল ক্রিটেশাস যুগে, প্রায় ১০ কোটি বছর আগে। জীবাশ্মবিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় ৬ কোটি বছর আগের ক্রিটেশাস-প্যালিওজিন বিলুপ্তির পর পাখিরাই চার উপাঙ্গবিশিষ্ট ডাইনোসরের একমাত্র বশংধর। কারন তখন সব প্রজাতির ডাইনোসরেরা বিলুপ্ত হয়েছিল কিন্তুু দক্ষিণ আমেরিকায় কিছু প্রজাতির পাখি ঐ ঘটনা থেকে বেঁচে গিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং বংশবৃদ্ধি করে। লিনিয়াসের নিয়ম অনুসারে পৃথিবীর সকল পাখির প্রজাতিকে এভিস শ্রেণীর আওতাভুক্ত করা হয়েছে আবার জাতিজনি শ্রেণীবিন্যাসে এভিসকে ডাইনোসরের শাখা থেরোপোডায়  অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। সরীসৃপ আর্কোসরিয়া ক্লেডের জীবিত বশংধর হচ্ছে  এভিস এবং তাদের সহযোগী গোষ্ঠী। বিজ্ঞানীদের মতে এদের সামনের দুটি উপাঙ্গ বহু বছরের বিবর্তনে অভিযোজিত হয়ে ডানায় রূপান্তরিত হয়েছে। পাখিরা দক্ষ শিকারি এবং সর্বভুক, তাই তারা এ গ্রহের সবকটি মহাদেশে বিস্তৃতিলাভ করেছে।

বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখি রয়েছে। যাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মৌ হামিংবার্ড (মাত্র ২ ইঞ্চি) আর সবচেয়ে বড় উটপাখি (৯ ফুট)তবে এ দুটি পাখি আমাদের দেশে নেই। কোন দেশের পাখির পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব জানাটা অনেকা কষ্টের কারণ পরিযায়ী পাখি এ হিসাব কে কম বেশি বানাতে পারে। বাংলাদেশে আবাসিক ও পরিযায়ী পাখিসহ প্রায় ৭১০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এর মধ্যে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিলে ৬৫০ প্রজাতির পাখি রক্ষিত প্রাণী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারপর ও বিভিন্ন গবেষণায় এটা জানা যায় যে, বাংলাদেশে প্রায় ৬২০ থেকে ৬৫০ প্রজাতির পাখি আছে এবং এদের মধ্যে প্রায় ১৪৫ প্রজাতির পাখিকে অনিয়মিত আখ্যায়িত করা হয়েছে কারণ কালেভদ্রে এদের দেখা যায়। বাকি প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে নিয়মিত দেখা যায়। এদের মধ্যে আবার প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখিকে বাংলাদেশের আবাসিক পাখি বলা হয় কারণ এরা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে এবং বাকি প্রায় ১৭৫ প্রজাতির পাখিকে পরিযায়ী পাখি বলে। এরা খন্ডকালের জন্য নিয়মিত এ দেশে আসে। এসব পরিযায়ী পাখির মধ্যে কিছু আছে পান্থ-পরিযায়ী মানে যারা এক আবাস থেকে আরেক আবাসে গমনের সময় সাময়িকভাবে অবস্থান করে।

যুগ যুগ ধরে পাখিরা পরিযায়ন করে আসছে। এটি প্রকৃতির একটি অদ্ভুত খেয়াল। পাখি পরিযানের অন্যতম দু’টি কারণ হচ্ছে খাদ্যের সহজলভ্যতা আর বংশবৃদ্ধি। আমাদের দেশ পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে। শীতকালে এখানে মূলত আরও উত্তরের দেশ থেকে পাখিরা দল বেঁধে আমাদের দেশে আসে। এদের বলা হয় পরিযায়ী পাখি। এরা আবার গ্রীষ্মকালে চলে যায়। এই পরিযায়ী পাখি আসার মূল কারণ খাদ্য সংগ্রহ। আমাদের দেশের আরও উত্তরে রাশিয়া, সাইবেরিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে শীতের সময় চারদিক বরফে ঢাকা পড়ে, তাপমাত্রা শূন্যের নিচে ৫০–৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। এ অবস্থায় সেখানে পাখিদের খাওয়ার প্রচণ্ড অভাব দেখা দেয়। তাই সেখান থেকে দল বেঁধে পাখিরা আমাদের মতো দেশে আসে মূলত খাদ্যের সন্ধানে।

বাংলাদেশে আমাদের চেনা-জানা পাখির সংখ্যা অনেক। দোয়েল, কোকিল, ময়না, টিয়া, কাক, পায়রা, চিল, ডাহুক, মাছরাঙা, পানকৌড়ি, কাকাতুয়া, বাবুই, কাঠঠোক্রা, চড়ুই, টুনটুনি, বুলবুলি, বউ কথা কও, শালিক, ঘুঘু, বক, বাংলা শকুন ইত্যাদি। এসব আমাদের খুব পরিচিত পাখি। এ দেশে কতরকম, কত ধরনের পাখি। পাখি অনেক রকমের রং-বেরঙের পাখি রয়েছে। এদের মধ্যে গানের পাখি, শিকারি পাখি, রাতের পাখি, ঝিল-পুকুরের পাখি, শীতের পাখি ও পোষা পাখি উল্লেখযোগ্য।

গানের পাখির মধ্যে অন্যতম দোয়েল। গরমের দিনে ঘরের পাশে, লেবুর ডালে, ডালিম শাখায় দোয়েল মনের সুখে গান করে। দোয়েলের মতো গানের গলা খুব কম পাখিরই আছে। শীতের সময় দোয়েল গান করে না। দোয়েল আমাদের জাতীয় পাখি। শীতের শেষে বসন্ত ঋতুর আগমনীবার্তা নিয়ে আসে কোকিল। কোকিলকে তাই বলা হয় বসন্তের দূত। দেখতে কালো হলেও কোকিলের গানের গলা খুবই মিষ্টি। কোকিল কখনো মাটিতে নামে না। গানের পাখির মধ্যে সবচেয়ে ছোট টুনটুনি। দেখতে ছোট হলেও টুনটুনির গানের গলা বেশ মিষ্টি আর জোরালো। টুনটুনি বেশিক্ষণ উড়ে বেড়াতে পারে না। শ্যামা, বুলবুলি, বউ কথা কও এরাও খুব সুন্দর গানের পাখি।

শিকারি পাখি মাছরাঙা, বাজপাখি, শকুন, চিল, বক ইত্যাদি। মাছরাঙা পুকুর পাড়ে মাটির গর্তে বাস করে আর সুযোগ বুঝে পানিতে টুপ করে ডুব দিয়ে ছোট মাছ ধরে খায়। বাজ আর চিল আকাশের অনেক উঁচুতে উড়ে বেড়ালেও দৃষ্টি থাকে নিচে। সুযোগমতো এরাও ছোঁ মেরে মুরগির ছানা ও অন্যান্য ছোট প্রাণী নিয়ে গাছের ডালে বসে খায়। বক দল বেঁধে আকাশে উড়ে বেড়ায়। আবার খাবার সময় হলে ঝিল-পুকুরের পাড়ে বসে মাছ ধরে খায়।

রাতের পাখি পেঁচা আর বাদুড়। এরা দিনের বেলা বের হয় না। পেঁচা বিভিন্ন পোকামাকড় ও ইঁদুর খেয়ে থাকে। বাদুড় গাছের ফল খায়। ঝিল-পুকুরের পাখি পানকৌড়ি, হাঁস, সারস, কোঁড়া। এরা ঝিল-পুকুরের পানিতে চরে বেড়ায় আর শামুক, ছোট মাছ ও জলের পোকামাকড় খেয়ে থাকে।

পোষা পাখি ময়না, টিয়া, কাকাতুয়া, শ্যামা, শালিক, ঘুঘু, পায়রা এসব পাখি ঘরে পোষা যায়। পোষা পাখির মধ্যে ময়না সবচেয়ে মজার পাখি। শিখিয়ে দিলে পোষা ময়না মানুষের মতো কথা বলতে পারে এবং মানুষের অনুকরণে নানা রকম শব্দ ও গান করতে পারে। ময়না কালো রঙের পাখি। তবে গলার কাছে একটি হলদে রেখা আছে। টিয়ে পাখির পালক হলদে শ্যামল, ঠোঁট লাল রঙের। শালিক, ঘুঘু ও কবুতর খুবই নিরীহ পাখি। মুরগি-হাঁস গৃহপালিত পাখি। এসব পাখি বাংলাদেশের প্রায় সব ঘরে দেখতে পাওয়া যায়। হাঁস ও মুরগির ডিম আমাদের খুবই প্রিয় খাবার।

কথাবলা পাখির গোটা বিশ্বে রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। কারণ এরা মানুষের কথাবার্তা হুবহু নকল করতে পারে। ভিমরাজ, ময়না, টিয়া,শালিক এসব পাখি বন্দী অবস্থায় এরা মানুষের কথা ছাড়াও বাচ্চার কান্না, থালাবাসনের শব্দ, কলিংবেলের শব্দ, বেড়ালের ডাক ইত্যাদি অবিকল অনুকরণ করতে পারে। তারা তীক্ষ্ন ও পরিষ্কার গলায় মানুষের মত শিষ দিতেও সক্ষম।

গ্রাম-গঞ্জে ফসলে কীটনাশক ব্যবহার পাখি বিলুপ্তির ক্ষেত্রে অনেকাংশেই দায়ী। কৃষকরা বিভিন্ন ফসলে সব সময় কীটনাশক ব্যবহার করেন। এতে পাখির খাদ্য ফড়িং, ফুতি, প্রজাপতি, মশা, লেদা পোকাসহ বিভিন্ন প্রকার কীটপতঙ্গ মারা যায় বা রোগে আক্রান্ত হয়। পাখি দিনের পর দিন এসব খেয়ে মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া শিকারিদের নিষ্ঠুরতা তো রয়েছেই। ফলে পাখির বিলুপ্তির কারণে যেমন জীববৈচিত্র্যের সংকট বাড়ছে, তেমনি হারিয়ে ফেলছে সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ।

১৭শ শতক থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপে ১২০ থেকে ১৩০টি পাখি প্রজাতি পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। তারও আগে আরও একশ’টির মত প্রজাতি একই ভাবে বিলুপ্তি হয়েছে । মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে বর্তমানে প্রায় বারোশ’র মত প্রজাতি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। কেবল মানব জাতির জীবের প্রতি দয়া, সহনশীলতা এবং সচেতনতাই রক্ষা করতে পারে পাখির স্বাভাবিক বেঁচে থাকা ও বংশ বিস্তারের পথ।

পাখি বাংলাদেশের প্রকৃতির এক মূল্যবান সম্পদ। শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও পাখির ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। পাখিরা খাদ্যচক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং এরা পরিবেশ পরিষ্কারক। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভারসাম্য রক্ষায় পাখির ভূমিকা অনস্বীকার্য।

লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট





আর্কাইভ