

শুক্রবার ● ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় করণীয়
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় করণীয়
প্রকাশ ঘোষ বিধান
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আলোচিত বিষয়। জলবায়ুর এ পরিবর্তন বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে অস্থায়ী কিংবা স্থায়ী নেতিবাচক এবং ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর জলবায়ুর স্বাভাবিক আচরণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত কুমেরু ও হিমালয়ের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, জলবায়ুর সাম্যাবস্থা ভেঙে যাওয়ায় বন্যা, খরা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ভূমিকম্প, সুনামি ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েই চলেছে।
বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হওয়ায় পৃথিবীর জলবায়ু অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। বস্তুত মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতেই বিশ্ব জলবায়ুতে পরিবর্তন ঘটছে, পরিবেশের বৈরী আচরণ আমাদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে এবং প্রতিনিয়ত প্রাণিকুলের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ঘরবাড়ি, গাছপালা, ফসলসহ প্রাণিকুলের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। সমুদ্রের পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এতে বিভিন্ন দেশের উপকূলীয় অঞ্চল পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ভূঅভ্যন্তরে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। এতে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের সৃষ্টি হচ্ছে। হিমবাহের ফলে বরফ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে বাতাসের সাথে মিশে অতি বৃষ্টির সৃষ্টি করছে। জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খনিজ সম্পদ আহরণ ইত্যাদির কারণে বনে অগ্নিকাণ্ড তথা দাবানলের সৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ুর ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নানা রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদনদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষি উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
আবহাওয়া হল কোনো নির্দিষ্ট স্থানের স্বল্পসময়ের বায়ুমণ্ডলের অবস্থা। কোনো নির্দিষ্ট স্থানের নির্দিষ্ট সময়ের বায়ুর উষ্ণতা, বায়ুচাপ, বায়ুপ্রবাহ, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি উপাদানের দৈনন্দিন অবস্থাই আবহাওয়া। আবহাওয়া হলো বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরের দৈনন্দিন অবস্থা। স্থানভেদে আবহাওয়া সহজেই পরিবর্তিত হয়। কোনো স্থানের আবহাওয়া প্রতিদিন, এমনকি প্রতি ঘণ্টায় পরিবর্তিত হয়। সাধারণত এক দিনের এমন রেকর্ডকেই আবহাওয়া বলে। আর জলবায়ু কোনো নির্দিষ্ট স্থানের সুদীর্ঘ সময়ের, সাধারণত ৩০-৩৫ বছরের আবহাওয়ার গড় বা সামগ্রিক অবস্থার হিসাব জলবায়ু। সাধারণত বৃহৎ এলাকাজুড়ে জলবায়ু নির্ণীত হয়ে থাকে। জলবায়ুর পরিবর্তন আবহাওয়ার পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল। কোনো স্থানের আবহাওয়ার পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কোন অঞ্চলের বায়ুর তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বস্তুর চাপ, বায়ু প্রবাহ, দৃষ্টিপাত, তুষারপাত, ঝড়, বায়ুপুঞ্জ, মেঘাচ্ছন্নতা ইত্যাদির দীর্ঘদিনের সামগ্রিক রূপকে ঐ স্থানের জলবায়ু বলা হয়। মূলত কোন স্থানের ২০-৩০ বছরের দৈনন্দিন আবহাওয়া পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে সে স্থানের নির্ধারণ করা হয় বা এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
গত কয়েক দশক ধরে পৃথিবী দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। এই উষ্ণায়নের ফলে আমাদের পরিবেশ এবং জীবজগতের উপর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। অনেক গবেষক মনে করেন ১৯০০ সাল থেকে পৃথিবীর জলবায়ু উষ্ণ হচ্ছে। তবে এ উষ্ণতা পৃথিবীর সর্বত্র সমানভাবে ঘটেনি। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় এ পরিবর্তন দৃষ্ট হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধি এবং সূর্যরশ্মি থেকে নির্গত শক্তির পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েছে। আবার বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এসে মানুষের কর্মকাণ্ডেই গ্রিন হাউজ গ্যাসের ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
শিল্পকারখানাতে নিঃসরিত সালফেট কণা সৌর বিকিরণকে প্রতিফলিত করে এবং এর ফলে এটি বায়ুকে শীতল রাখে। এ সালফেট কণা ১৯৪০ সাল থেকে বেশ কয়েক দশক পর্যন্ত উষ্ণতাকে আড়াল করে রেখেছিল, কিন্তু এই বিষাক্ত পদার্থগুলো কমে যাওয়ার ফলে এবং গ্রিন হাউজ গ্যাসের ঘনত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় সত্তর দশক থেকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯৮০ দশক থেকে গ্রিন হাউজ গ্যাসের প্রভাবে প্রতিবছর পৃথিবীর তাপমাত্রা গড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে ০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রতিনিয়ত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সুমেরু অঞ্চলের বরফ গলার পরিমাণ আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এভাবে পৃথিবীর জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন প্রাণিকুলের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং মানব সমাজের উপর প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে, আবহাওয়া আরও চরম হচ্ছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে অনেক কারণ নিহিত রয়েছে। যদিও জলবায়ুর স্বাভাবিক আচরণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পেছনে মূলত মানুষই দায়ী। পৃথিবীর জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে জলবায়ু বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বাড়তি জনসংখ্যার বসবাসের স্থান, কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি, খাদ্য চাহিদাসহ মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের জন্য দিন দিন জলবায়ুর ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের গতিকে ত্বরান্বিত করছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন মাটি দূষণ, ভূমিধস, পানি দূষণ ইত্যাদির মাধ্যমে জলবায়ুর পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে। বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তরের ক্ষয়ের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে এবং বায়ুমণ্ডলে অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে নানা ধরনের মারাত্মক রোগব্যাধি দেখা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী রাসায়নিক পদার্থ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। বিলাসদ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যাপক ব্যবহারে বায়ুমণ্ডলে সিএফসি, মিথেন, ওজন, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতি গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিশ্ব জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। ক্ষতিকর পারমাণবিক পদার্থের ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত মরণাস্ত্রের ব্যবহার মানবজীবন ও জীববৈচিত্র্যকেও হুমকির মুখে ঢেলে দিচ্ছে। অবাধে বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে বনভূমি উজাড় হওয়ার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। আগ্নেয়গিরির উদগিরণও বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যও দায়ী।
জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ হলো বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। আর বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ গ্রিন হাউজ গ্যাস। গ্রিন হাউজ ইফেক্ট বলতে পৃথিবীর অভ্যন্তরে সার্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বোঝায়। সূর্য থেকে যে তাপশক্তি পাওয়া যায় পৃথিবী থেকে তা বিকিরণের মাধ্যমে আবার মহাশূন্যে ফিরে যায়। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ ইফেক্টের জন্য প্রচুর পরিমাণ সিএসফি, মিথেন ইত্যাদি গ্যাসজমে থাকার ফলে ভূপৃষ্ঠের তাপ বিকিরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আবার ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসায় ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে খাদ্য ও পানি নিরাপত্তাব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ভেঙে পড়বে, বাস্তুচ্যুত হবে মানুষ। কিন্তু জনগণের যে অংশ বাড়িঘর ছেড়ে যেতে পারবে না, তারা জীবন-হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সহিংসতা বৃদ্ধি পাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কেবল তাপমাত্রা বাড়বে না, বর্ষা হবে দীর্ঘমেয়াদি ও বাড়বে খরা। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এশিয়ার ৪ কোটি মানুষ জলবায়ুজনিত উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।
জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করা সম্ভাব না। একইভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াও পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়কারী কাজগুলো পরিহার সম্ভব। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে যেসব নিরাপত্তাঝুঁকি সৃষ্টি হবে, সেগুলো মোকাবেলা করার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক যৌথ ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার যে আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার, তা পূরণে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে জলবায়ু সংকট মোকাবেলা করার সক্ষমতা ও অভিযোজনের ওপর। এ অভিযোজন যাতে পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। নদী, পলি ও পানি ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে। সবুজ অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশ সচেতন নাগরিক ও রাষ্ট্রই আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম। শুধু পরিকল্পনা নয়, এক্ষেত্রে বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সারা বিশ্বই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ থেকে আমাদের রক্ষা পেতে অধিক হারে বৃক্ষ রোপন করতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ বৃক্ষই পারে অধিকমাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন উৎপন্ন করতে।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট