শনিবার ● ১৩ আগস্ট ২০১৬
প্রথম পাতা » ফিচার » চির ভাস্বর বাঙ্গালী জাতির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু
চির ভাস্বর বাঙ্গালী জাতির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু
প্রকাশ ঘোষ বিধান
বাঙালী জাতির বেদনা বিধুর শোকের মাস আগষ্ট। সর্বত্রই শোকের আবাহ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ শোক তার জন্য, এ শোক জাতির পিতার জন্য। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীনতার নতুন সূর্য উদিত হয়। দাসাত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে বাঙালী জাতি যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনে লাল-সবুজের স্বাধীন পতাকা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও নির্দেশে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঘটে। বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, স্বাধীন পতাকা। আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তিনিই তো ছিলেন বাঙালীর স্বপ্ন ও বাস্তবতার সার্থক রূপকার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি আন্দোলন থেকে একটি সংগ্রাম এবং সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশের স্থপতি। তিনি একটি দেশ ও একটি জাতির ইতিহাস। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা রেডিও সার্ভিস পরিচালিত বিশ্বব্যাপী শ্রোতা জরিপে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী নির্বাচিত হন। বারবার তার সামনে এসেছে মসনদ, ক্ষমতা, অর্থবিত্তের হাতছানি। মোহ ও লোভ কখনও ছুতে পারেনি জাতির পিতাকে। নানা ষড়যন্ত্রে কুটচালে চেষ্টা করেছে তাকে সরিয়ে দিয়ে পথ থেকে, আন্দোলন থেকে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। শেষাবধি তাই বিপথগামী ঘৃণ্যত একদল সেনা সদস্যরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকদের হাত থেকে সে দিনে বঙ্গবন্ধুর শিশু পুত্র শেখ রাসেলও রক্ষা পায়নি। নিহত হন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বড় ছেলে শেখ কামাল, মেঝ ছেলে শেখ জামাল, পুত্রবধু সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি, বেগম আরজু মনি, কর্ণেল জামিল, ভাই শেখ আবুু নাসের, কাজের মেয়ে বকুল সহ ১৬ জন ঘাতকের হাত থেকে রেহায় পায়নি। সেদিন দেশে না থাকায়প্রাণে রক্ষা পান ২ কণ্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। আজ তারই সুযোগ্য কণ্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে রুপান্তরিত হচ্ছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট মাত্র ৫৫ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু হত্যার শিকার হন। এ হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে বাংলাদেশের রাজনীতি পাকিস্থানি ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। ইতিহাসের যিনি স্রষ্টা, বাঙালী জাতির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়ে যিনি এক অসাধারণ ইতিহাসের নির্মাতা হিসাবে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি ও পরিচিতি অর্জন করেছেন তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা কোন দিন সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হতো না। আমরা একটি স্বাধীন মানচিত্র, ভূখণ্ড, পতাকা ও পার্সপোর্ট পেতাম না। যিনি সারা জীবন স্বপ্ন দেখে ছিলেন উপমহাদেশের এই অঞ্চলের বসবাসকারী বাঙালীর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রণ্ট নির্বাচন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ঐতিহ্যসীক ৬ দফা আন্দোলন, ৭০ এর নির্বাচন, ৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি ছিলেন বাঙালীর কান্ডারি। সমাজ ও রাজনীতিতে সবাই নেতার স্থান করে নিতে পারে না। হাতেগোনা গুটি কয়েক মানুষের পক্ষেই কেবল তা সম্ভব হয়। তাদের মধ্যে বড় অসাধারণ গুনাবলী সম্পন্ন ব্যক্তি বড় নেতা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। আর বড় নেতা হলেই একজন ব্যক্তি ইতিহাসের নেতা হয়ে ওঠে না। ইতিহাসের নেতা হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির জন্ম সব কালে, সব যুগে হয়না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বড় নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন যথার্থভাবে ইতিহাসের নেতা ও ইতিহাসের মহানায়ক। তিনি সাধারণ মানুষের বন্ধু, জাতির কাছে তিনি পিতা, পৃথিবীর সকলের কাছে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। সাংবাদিক শেরিল ডান বলেছেন, বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলেন একমাত্র নেতা যিনি, রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, সংস্কৃতিতে এবং জন্মে একজন পুর্ণাঙ্গ বাঙালী। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অসিম। তার কণ্ঠ বজ্র কঠিন। তার মোহনীয় ব্যক্তিত্বে সহজেই আবিষ্ট হয় সাধারণ মানুষ। তার সাহস এবং অনুপেরণা শক্তি তাকে এই সময়ের অনন্য সেরা মানব এ পরিণত করেছে। নিউজ উইক পত্রিকা তাকে “রাজনীতির কবি” হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে নন এ্যালাইনড সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কোলাকুলী করার সময় কিউবার নেতা ফিডেল ক্যাট্রো বলেন, আমি হিমালয় দেখি নাই, কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব এবং সাহসীকতায় তিনি ছিলেন হিমালয়সম, আর এ ভাবেই আমার হিমালয় দর্শন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হলেও তার চেতনাকে হত্যা করা যায়নি। তাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধারা আজও আরো জীবন্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু জাগ্রত রয়েছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। তিনি চিরঞ্জীব থাকবেন মানুষের অন্তরে। ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বদলে ফেলে দেশকে সাম্প্রদায়িক, সামরিক স্বৈরাচারী, পুজিবাদী, লুটপাটতান্ত্রীক, সামজ্যবাদের পথে ঠেলে নামানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যদিয়ে ইতিহাসের গতিধারাকে উল্টে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর সে উল্ট ধারাতে চলেছে দেশ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সাথে সাথেই রাষ্ট্রীয় নীতি বদলানো হয়েছিল, তার থেকে প্রমাণ হয় মুক্তিযুদ্ধের এ চার নীতি বদলানোর জন্য স্বপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। ইতিহাসে যিনি স্রষ্টা, বাঙালী জাতির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়ে যিনি এক অসাধারণ ইতিহাসের নির্মাতা হিসাবে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি ও পরিচিতি অর্জন করেছেন, তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার রাজনৈতিক মূঢ়তা কোনভাবেই জয়যুক্ত হতে পারে না। শত ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ঘৃণিত খুনীদের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এখনো বেশ কয়েকজন মৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর খুনী বিদেশে পালিয়ে থেকে ষড়যন্ত্র করছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হোক এটা সকলের দাবী।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট থেকে কাঁন্না শুরু। এ কাঁন্না থামার নয়। আগষ্ট এলেই তাই কাঁদে বাঙালী।এটি বেদনার, বাঙালীর মন খারাপের মাস। বাঙালীর হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু আজও চিরঞ্জীব। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত, সব খানে, সমানভাবে জুড়ে রয়েছেন। আলোয় উদ্ভাসনে, সংকটে ও সম্ভাবনায়, বাঙালীর চির মানষপটে চিরসমুজ্বল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। তিনিই তো বাঙালীর সহস্র বছরের অবিস্মবনীয় এক রাজনৈতিক নেতা, বাঙালী জাতির পিতা।
লেখকঃ সাংবাদিক