

মঙ্গলবার ● ১১ মার্চ ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » নদী তার প্রাণ ফিরে পাক
নদী তার প্রাণ ফিরে পাক
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। শতাধিক বড় বড় নদী জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে এ দেশজুড়ে। কালের বিবর্তনে বর্তমানে অনেক নদ-নদী সংকটাপন্ন। নদী হারাচ্ছে তার বৈশিষ্ট্য, অন্যদিকে দূষণের মাত্রাও বাড়ছে। বিশেষ করে পানিতে বর্জ্য মিশ্রণের ফলে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে নদীগুলো। বর্তমানে অনেক নদ-নদী সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। বিভিন্ন স্থানে এসব নদ-নদী ভরাট হয়ে গেছে। এতে ভাটির জনপদে নৌপথ বন্ধ, চাষবাসে সংকট, অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
নদী পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে অপরিহার্য। নদী হারাচ্ছে তার বৈশিষ্ট্য, অন্যদিকে দূষণের মাত্রাও বাড়ছে। বিশেষ করে পানিতে বর্জ্য মিশ্রণের ফলে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ভাটির জনপদের নদীগুলো। উৎসমুখসহ বিভিন্ন স্থানে গতিপথ পরিবর্তন, নাব্য হারিয়ে নদীভাঙন ব্যাপক হচ্ছে। তীরবর্তী জনপদের জীবন-জীবিকা বদলে যাচ্ছে। বিলীন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
সবুজ-শ্যামল সজল প্রকৃতি প্রাণের বৈচিত্র্য মানেই বাংলাদেশ। এই প্রাকৃতিক বৈচিত্রের প্রাণশক্তিই হলো দেশের ৭ হাজার নদ-নদী জলাভূমি। সেই সঙ্গে আমাদের এসব নদীর সাথে জড়িয়ে আছে প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য, জীবন-জীবিকা, জীববৈচিত্র্য। সচেতনতা ও সংরক্ষণের অভাবে নদীর ধার ঘেঁষে গড়া প্রাচীন নগরীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভুলতে বসেছে। নদীকে ঘিরে মাঝি-মাল্লা, জেলেসহ অজস্র জনগোষ্ঠী জীবিকা হারিয়েছে। ভরাট, দখল দূষণে অজস্র প্রাণীর বিতাড়ন ও বিলুপ্তিতে জীববৈচিত্র্যও সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখে।
১৪ই মার্চ আন্তর্জাতিক নদী কৃত্য দিবস। যাকে আরেক ভাবে বলা হয়, আন্তর্জাতিক নদী রক্ষায় করণীয় দিবস। নদীর প্রতি তাই দায়বদ্ধতা মনে করিয়ে দিতে ১৪ মার্চ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। ১৯৯৭ সালের মার্চে ব্রাজিলের কুরিতিয়া শহরে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশ থেকে আন্তর্জাতিক নদী কৃত্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। নদীর প্রতি মানুষের করণীয় কী, নদী রক্ষায় দায়িত্ব, মানুষের দায়বদ্ধতা কতটুকু; এসব বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নদী সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ও মানুষের মধ্যে নদী ভাবনা তৈরি করতে গ্রীন ভয়েস জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশের নদী বাংলাদেশের প্রাণ দেশ বাঁচাতে নদী বাঁচান এই স্লোগান নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
নদীই একটি জীবন্ত সত্তা। ২০১৯ সালে ৩ ফেব্রুয়ারি আমাদের দেশের মহামান্য হাইকোর্ট একটি রায়ে নদীকে জীবন্ত সত্তা (লিভিং এনটিটি) বলে আদেশ জারি করেছে। এর অর্থ মানুষের মতো নদীরও সুস্থ সুন্দর থাকার অধিকার রয়েছে। নদনদী দখল আর দূষণের শিকার হয়ে নদী গতি হারাচ্ছে। নিয়মনীতি উপেক্ষা করে নদীর ধারে গড়ে উঠেছে বড় বড় কলকারখানা, নদীতে শত শত বাঁধ। যখন যেভাবে প্রয়োজন তখন সেভাবে নদীকে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রভাবশালীরা নদী ভরাট করে দখল করার উৎসবে মেতে উঠেছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ এখন নদীর অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। দখলদারদের দৌরাত্ম্যে অনেক নদ-নদী ভরাট হয়ে অস্তিত্ব হারিয়েছে। দখল, দূষণ, বালু ও মাটি উত্তোলনসহ নানা কারণে চরম সংকটে পতিত হয়েছে নদীগুলো। দখল হওয়া নদী ও বিভিন্ন স্থানে গতিপথ পরিবর্তন, নাব্য হারিয়ে নদীভাঙন ব্যাপক হচ্ছে। এসব নদী মরে যাওয়ায় চাষবাসে সংকট, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এ নদীগুলো বাঁচানোর আকুতি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছেন পরিবেশবাদীরা।
বর্তমানে বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা প্রায় ১,০০৮ টি। এ নদ-নদীগুলোর উপনদী ও শাখানদী রয়েছে। উপনদী শাখানদীসহ বাংলাদেশের নদীর মোট দৈর্ঘ্য হলো প্রায় ২২,১৫৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা কত এটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তালিকা দেশে বর্তমানে জীবন্ত নদ-নদীর সংখ্যা এক হাজার আট। দীর্ঘতম নদী পদ্মা। দেশের তিন বিভাগের ১২টি জেলায় প্রবাহিত নদীটির দৈর্ঘ্য ৩৪১ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে দেশে ২২ হাজার কিলোমিটারের দীর্ঘ নদীপথ রয়েছে। দেশে বর্তমানে ২০০ কিলোমিটারের বেশি নদী রয়েছে ১৪টি। এ ছাড়া ১০০ থেকে ১৯৯ কিলোমিটারের নদী রয়েছে ৪২টি, ১০ থেকে ৯৯ কিলোমিটারের নদী ৪৮০টি এবং ১ থেকে ৯ কিলোমিটারের দৈর্ঘ্যের নদীর সংখ্যা ৩৭৬টি। এক কিলোমিটারেরও কম দৈর্ঘ্যের নদী রয়েছে ৪১টি। সবচেয়ে বেশি নদী রয়েছে সুনামগঞ্জ জেলায়, ৯৭টি। ৯ আগস্ট নদী রক্ষা কমিশন তাদের ওয়েবসাইটে ৯০৭টি নদ-নদীর খসড়া তালিকা প্রকাশ করে। কমিশনে জমা পড়া সব মতামত ও আপত্তি নিষ্পত্তি করে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়, যেখানে নদীর সংখ্যা বেড়েছে ১০১টি। কমিশন জানিয়েছে, এই তালিকায় নদীর সংখ্যা সংযোজন ও বিয়োজনের কাজ চলমান থাকবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় দেশে বর্তমানে এক হাজার ১৫৬টি নদ-নদী প্রবহমান আছে বলে একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের নদ-নদীর সংখ্যা নির্ধারণবিষয়ক সেমিনারে এই তালিকা প্রকাশ করা হয়। এই তালিকায় ৩৬৫টি এমন নদীর নাম যুক্ত করা হয়েছে, যেটা ২০১১ সালে বাপাউবো কর্তৃক প্রকাশিত ৪০৫টি নদী এবং ২০২৩ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এক হাজার আটটি নদী তালিকায় ছিল না।
অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করে। বালু উত্তোলন নদীর ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশকে প্রভাবিত করে, নদীগুলোর বাস্তুসংস্থান নষ্ট করে। বর্তমানে বালু উত্তোলনের জন্য সরকারিভাবে দেশের ৭০৭টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। যেগুলো বালুমহাল নামে পরিচিত। যার মধ্যে ৩৮২টি বালুমহাল বিভিন্ন ব্যক্তিকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বালু উত্তোলন মানচিত্র-২০২৩ শিরোনামে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের ৭৭টি নদীর ১৩২টি পয়েন্ট থেকে ২৬৫ ব্যক্তি অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন। সমীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২৬৫ জনের মধ্যে অন্তত ৫৪ জন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। প্রতিবেদন অনুসারে, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও সুরমা বালু নদী থেকে সবচেয়ে বেশি বালু উত্তোলন করা হয়।১৩২টি অবৈধ বালু উত্তোলন কেন্দ্রের মধ্যে পদ্মায় ২০টি, যমুনায় ১৩টি, মেঘনায় ১২টি, ব্রহ্মপুত্রে ছয়টি, সুরমা ও পিয়াইন নদীতে পাঁচটি, তিস্তায় চারটি, সাঙ্গুতে তিনটি এবং ইছামতিতে তিনটি কেন্দ্র রয়েছে। বাকিগুলো দেশের অন্যান্য নদীতে অবস্থিত। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরের অন্তত সাতটি কেন্দ্র থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। সম্প্রতিকালে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর প্রধান সম্পদ হচ্ছে উজান থেকে আসা পানির প্রবাহ। নদ-নদীর পানির ওপর ভর করে দেশের কৃষি ও বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবিকা চলে। বর্ষাকালে পানির পরিমাণ বেশী আসায় বন্যা ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। আর শুস্ক মৌসুমে যখন পানি দরকার তখন পানি কম আসছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে এসব বিপদ তৈরি হচ্ছে।
পৃথিবী জুড়ে নদী প্রাগৈতিহাসিক যুগ ধরে মানবসভ্যতা গড়ে তোলার জন্য অবিরত অবদান রেখে চলেছে, সেই নদীর উপরই মানবজাতি অবিবেচক, অকৃতজ্ঞ ও নিষ্ঠুরের মতো বর্বর আচরণ করে চলেছে। লোভী মানুষের দখলাভিযান, শিল্পায়ন ও কৃষিক্ষেত্রের কীটনাশকের ভয়ংকর দূষণ এবং নদীর প্রবাহে নানা কৃত্রিম অবরোধ সৃষ্টি করে নদ-নদীসমূহকে হত্যার আয়োজনে নির্বিচারভাবে মত্ত মানুষ। তাছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের সঙ্কট এবং অন্যান্য দুর্যোগে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত নদীগুলোকে পুনরুদ্ধার করতে সরকার, আদালত, বিভিন্ন সংস্থা এবং সুশীল সমাজকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
নদী রক্ষায় দেশের নদনদী যথাযথ তালিকা প্রণয়ন ও তা গেজেটের মাধ্যমে প্রকাশ করা দরকার। নদীর আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সংরক্ষণ, উন্নয়নে জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনসহ সচেতন ব্যক্তি, সমাজ, সংগঠনকেও এগিয়ে আসতে হবে। দেশের নদী সমূহকে বাঁচাতে হবে, ভালো রাখতে হবে। নদী ভালো না রাখলে আমরা ভালো থাকব না। নদী বাঁচলে সভ্যতা টিকবে না। নদীর আইনি অধিকার রক্ষায় সকলের এগিয়ে আসা দরকার।