

শুক্রবার ● ১৮ এপ্রিল ২০২৫
প্রথম পাতা » মুক্তমত » নিজেদের বাঁচাতে ধরিত্রী রক্ষায় করণীয়
নিজেদের বাঁচাতে ধরিত্রী রক্ষায় করণীয়
প্রকাশ ঘোষ বিধান
ঃ ২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস। পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা তৈরিতে প্রতিবছর ২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস উৎযাপন করা হয়। এটি জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত একটি দিবস। ধরিত্রী শব্দটি এসেছে ধরণী বা ধরা থেকে, যার অর্থ হলো পৃথিবী। এর অপর নাম পৃথ্বী। এর সমার্থক শব্দ হচ্ছে; বসুধা, বসুন্ধরা, ধরা, ধরনী, ধরিত্রী, ধরাতল,ক্ষিতি, ভূমি, মহী, দুনিয়া ইত্যাদি। পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য সর্বসমেত ধার্য করা একটি দিবসই হলো ধরিত্রী দিবস।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে, পৃথিবী না থাকলে মানুষের জীবন অস্তিত্বহীন। মানুষ, প্রাণিকুল বাঁচাতে পৃথিবী রক্ষা করা দরকার। পৃথিবীকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে। অতিলোভী মানুষ প্রকৃতির সম্পদের অপব্যবহার করেছে। তাতে জীবন দুর্বিষহ অবস্থায় পড়েছে। মানুষের অপরিণামদর্শি কর্মকাণ্ডে আজকের ধরিত্রী জর্জরিত।
ধরিত্রী দিবস বা বিশ্ব বসুন্ধরা দিবস পরিবেশ রক্ষার জন্য সমর্থন প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ২২ এপ্রিল পালিত হয়। ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল প্রথমবার পালিত হয়েছিল এই দিবস। ১৯৬৯ সালে সান ফ্রান্সিসকো-তে ইউনেসকো সম্মেলনে শান্তি কর্মী জন ম্যাককনেল পৃথিবী মায়ের সম্মানে একটা দিন উৎসর্গ করতে প্রস্তাব করেন। তবে ১৯৭০-এর ২১ মার্চ উত্তর গোলার্ধে বসন্তের প্রথম দিনে এই দিনটি উদ্যাপিত হয়। পরবর্তীতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটর গেলর্ড নেলসন ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল আর্থ ডে এর প্রচলন করেন। পৃথিবীর অনেক দেশেই সরকারিভাবে এই দিবস পালিত করা হয়। উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে বসন্তকালে আর দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলিতে শরতে ধরিত্রী দিবস পালিত হয়। তবুও আজ পৃথিবী সংকটের মুখে। তাই প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে, পৃথিবীকে সুরক্ষিত ও বাসযোগ্য রাখতে বিভিন্ন দেশে এই দিনটি পালন করা হয়।পৃথিবীর প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে জনগণের সচেতনা সৃষ্টি করে পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পরিবেশ ও জলবায়ুর গুরুত্ব কতখানি, সে সম্পর্কে জনসাধারণকে বার্তা দেওয়া হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জর্জরিত। সমগ্র বিশ্ব এখন জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই–অক্সাইডের ঘনত্ব বেড়েই চলছে, যা ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরূপ। জীবাশ্ম জ্বালানির অতি ব্যবহার বায়ুমণ্ডলের এই ঘনত্ব বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানিতে উচ্চ পরিমাণে কার্বন থাকে। মৃত গাছের পাতা, মৃতদেহ ইত্যাদি জীবনের উপাদান হাজার হাজার বছর ধরে মাটির নিচে চাপা পড়ে এ জ্বালানি তৈরি হয়। কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল ইত্যাদি জীবাশ্ম জ্বালানি। পাশাপাশি নির্বিচার বন উজাড় করা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করা এবং জৈব জ্বালানি পোড়ানোর মতো মানুষের নানাবিধ ক্রিয়াকলাপও অনেকাংশে দায়ী।
প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মাটির ক্ষয়, পানি দূষণ এবং বন উজাড়ের মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেকাংশে মানুষের কার্যকলাপ পরিবেশের ক্ষতির মূল কারণ। বিশ্বে এখন এই যে ঘন ঘন ভূমিকম্প, খরা, অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল এর সবই মানুষের লোভে ডেকে আনা।
মানবজাতি প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। যেখানে মানবজাতির আগমন অনেক পরে। মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রকৃতির সবকিছু একপক্ষীয়ভাবে ভোগ করে আসছে, মানুষ তার চাহিদার সীমানাকে নির্দিষ্ট করতে ভুলে গেছে। মানুষ তার ভোগ-বিলাসপূর্ণ অফুরন্ত চাহিদা আর উন্নত জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন বন উজাড় করছে,পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তোলা ও সমুদ্র সৈকতে আবাসিক এলাকা করছে। কলকারখানার বৃদ্ধি, গ্রিনহাউস গ্যাসসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক গ্যাসের নিঃসরণ, ক্ষতিকারক কেমিক্যালের ব্যবহারসহ নানা ধ্বংসাত্মক কাজ করায় ফল হিসেবে মাটি, পানি, বায়ুদূষণ, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বরফ গলে সাগরের উচ্চতা বাড়ছে। ফলে ইতিমধ্যে তলিয়ে গেছে বিশ্বের বহু জনপদ। বিশ্বে এখন এই যে ঘন ঘন ভূমিকম্প, খরা, অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল নামছে তা মানুষে অপরিণামদর্শিতার কারণে ঘটছে। বিশ্বের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি কার্বনের নিঃসরণ না কমে বরং তা বাড়ছে। এতে মানুষের দেহে অনেক নিরাময়–অযোগ্য ভয়াবহ রোগের আক্রমণ হচ্ছে।
ধরিত্রীর বয়স আনুমানিক ৪৫০ কোটি বছর। দীর্ঘ পরিক্রমায় ধরিত্রী যেমন সুগঠিত হয়েছে, ধারণ করেছে প্রাণ-অপ্রাণসহ নানা প্রাকৃতিক উপাদান। ধরিত্রী নিজস্ব নিয়মশৃঙ্খলে আবদ্ধ। ধরিত্রীর এ শৃঙ্খল তার প্রতিটি উপাদানকে একটি একক নিয়মে আবদ্ধ করে রাখে। এ নিয়মের ব্যতিক্রম হলেই দেখা দেয় বিপর্যয়। তাই যখন ধরিত্রীর এই শৃঙ্খলে কোনোভাবে আঘাত আসে, তখন তার প্রভাব প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের ওপর পড়ে। প্রকৃতি যখন বিরূপ হয় মানুষ তখন অসহায় হয়ে পড়ে। মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতি যেন মাতৃশ্রদ্ধা পায়। তাই আমাদের প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে সম্মান করা উচিত।
পৃথিবীর অস্তিত্বসংকটের জন্য প্রকৃতি দায়ী নয়, মানুষ দায়ী। আর তাই পৃথিবী রক্ষার দায়িত্বও আমাদের নিতে হবে। কেন পৃথিবীর ক্ষতি হচ্ছে এবং কীভাবে তা কমানো যায় তা জানার জন্য সচেতনতা প্রয়োজন। ধরিত্রীকে রক্ষায় কার্বন নিঃসরণ কমানো, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় মানুষকে সচেতন হতে হবে। জীবন ধারণের জন্য মানুষকে পরিবেশ-প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হয়। পৃথিবী সুস্থ না থাকলে মানুষও বেঁচে থাকার সুযোগ নেই। তাই অসুস্থ পৃথিবীকে ধীরে ধীরে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। তার জন্য মানুষকে পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য আমাদের কিছু দায়িত্ব আছে, কারণ প্রকৃতি সমস্ত উজাড় করে দিয়েছে মানুষের জন্য। আমাদের বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন দেয় গাছ। তবে নগরায়নে গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রকৃতিকে বাঁচাতে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে, গাছের যত্ন নিতে হবে। আমাদের অনেক প্রয়োজনেই গাছ কাটতে হয়, তার বিপরীতে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পাত্র, পলিথিনের ব্যাগ ও প্লাস্টিক বর্জ্য মাটির সাথে মিশে না। বছরের পর বছর এগুলো মাটির উপরে,পানির মধ্যে থেকে মাটি-পানি-বাতাস দূষিত করছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে, যেটা পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তবে এগুলো একেবারে পরিহার করা সম্ভব নয়, তবুও এর ব্যবহার সীমিত পর্যায়ে আনতে হবে। একটি নিরাপদ, টেকসই ও সুন্দর ধরিত্রীর জন্য আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানি যথাসম্ভব কম ব্যবহার করতে হবে। দূরবর্তী স্থানে যাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার না করে পাবলিক যানবাহন ব্যবহার করা। কাছাকাছি পথ অতিক্রম করতে হাঁটা বা সাইকেল ব্যবহার করা।
নিজেদের জন্য ধরিত্রী রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। ধরিত্রী মায়ের মতন আমাদের আগলে রেখেছে। পৃথিবী না থাকলে মানুষের জীবন অস্তিত্বহীন। তাই পৃথিবী রক্ষার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে।
লেখক ; সাংবাদিক ও কলামিস্ট