সোমবার ● ২৮ আগস্ট ২০১৭
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » সকালের রান্নাঘর, দুপুরেই নদী গর্ভে বিলীন
সকালের রান্নাঘর, দুপুরেই নদী গর্ভে বিলীন
নড়াইলে মধুমতি নদীর অব্যাহত ভাঙনে একটি গ্রাম ও প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে ॥
ভেঙ্গেছে মসজিদ ও কবরস্থান, ঈদ আনন্দ নেই এলাকাবাসীর মনে
নড়াইলে মধুমতি নদীর ভাঙনে রক্ষা হলো না শেষ বাড়িটিও
‘চুরি করে নিলেও ঘরবাড়ি থাহে, আগুনে পুড়লেও পোতা (ভিটেমাটি) থাহে; কিন্তু নদীতে ভাঙলে কিছুই থাহে না। নদীর কাজ নদী করে যাচ্ছে, দিনরাত ভাঙ্গে যাচ্ছে। ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা নেই।’
‘সকালে যেহানে রান্না করে খালাম, দুপুরে গেল নদীর প্যাটে’
১০ বছরে তেতুলিয়া এলাকায় মধুমতি নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়েছে ৯০০ পরিবার
“আমার নির্বাচিত এলাকার মধ্যে ‘তেতুলিয়া’ ওয়ার্ড মানচিত্রে থাকলেও দৃশ্যমান নেই। এখানে কোনো জনবসতি থাকার মতো অবস্থা নেই। নদী ভাঙনে সব শেষ হয়ে গেছে।”-লোহাগড়া ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল সিকদার
ফরহাদ খান, ভাঙন কবলিত এলাকা থেকে ফিরে
‘সকালে যেহানে রান্না করে খালাম, দুপুরে গেল নদীর প্যাটে। অবস্থা বেগতিক দেহে (দেখে) রাত ১২টার দিকে নিজেরাই ঘর ভাঙা শুরু করলাম। এই ভাঙনে ছয়টি নারকেল গাছ, ২০টি আম, ৩০টি কাঁঠাল, ১৫০টি সুপারি ও ৩০০ মেহগনি গাছসহ সবকিছু নদীর মধ্যে চলে গেছে। আর বসতভিটার ৪৫ শতক জমিও এহন (এখন) নদীর প্যাটে।’ কথাগুলো বলছিলেন মধুমতি নদী ভাঙনে নিঃস্ব নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার চরবকজুড়ি গ্রামের মনি মোল্যার স্ত্রী গোলজান বেগম (৫৪)।
গোলজানদের বাড়ি আগে ছিল তেতুলিয়ায়; গ্রামটি নদীতে বিলীন হওয়ার পর চরবকজুড়িতে এসে বাড়ি করেন। সেখানেও ভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন তারা। এভাবেই মধুমতি নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে লোহাগড়া উপজেলার তেতুলিয়া গ্রাম। গত ১০ আগস্ট তেতুলিয়া গ্রামের শেষ বাড়িটিও মধুমতি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তেতুলিয়া গ্রামটি জেলার মানচিত্রে থাকলেও আর দৃশ্যমান নেই। এখন চরবকজুড়ি ও কামঠানা গ্রামও বিলীনের পথে। গত ১৫ দিনের মধ্যে নদীগর্ভে চলে গেছে এ এলাকার ৩০টি বসতভিটা, বাড়িঘর ও বহু গাছপালা। এছাড়া প্রায় দুই বছর আগে নদীতে বিলীন হয়েছে তেতুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঁচ বছরের ব্যবধানে তেতুলিয়ার দু’টি কবরস্থান এবং ১০ বছর আগে তেতুলিয়ার একমাত্র মসজিদটিও। তবুও ভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
লোহাগড়া উপজেলার লোহাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৬নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত তেতুলিয়া গ্রাম। এই ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) চাঁন মিয়া মোল্যা জানান, নবম সংসদ নির্বাচনের সময় তেতুলিয়া গ্রামে ভোটার সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০জন। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ৪৫০জন; এই ভোটারের মধ্যেও বেশির ভাগ ভাড়া থাকেন জেলা ও উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন এলাকায়। সর্বশেষ তেতুলিয়া গ্রামে নান্নু মোল্যাদের বাড়িতে তিনটি পরিবারে ভোটার সংখ্যা ছিল ১৯জন। গত ১০ আগস্ট মধুমতি নদীর ভাঙনে নান্নুদের বাড়িটিও শেষ রক্ষা হয়নি।
এদিকে, গত ১০ বছরে তেতুলিয়া গ্রামের ৪০০ পরিবার নদী ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়েছে। এছাড়া কামঠানা, চরবকজুড়ি ও ছাগলছিড়া গ্রামের প্রায় ৫০০ পরিবার মধুমতি নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
চাঁন মিয়া মোল্যা বলেন, অনেক পরিবার সাতবার পর্যন্ত বাড়িঘর সরিয়েও রক্ষা পায়নি, গ্রাস করেছে মধুমতি নদী। তবুও পাউবো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ভাঙনরোধে এই এলাকায় এক ইঞ্চি কাজও করেনি।
তেতুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শওকত হোসেন বলেন, ২০১৫ সালের আগস্টে বিদ্যালয়টি নদীগর্ভে চলে যায়। এরপর কামঠানা এলাকায় টিনের ছোট একটি ঘরে ক্লাস নেয়া হচ্ছে। জোয়ারের সময় শ্রেণিকক্ষেও পানি উঠছে। ভাঙন প্রতিরোধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে বর্তমানে যেখানে ক্লাস নেয়া হচ্ছে, সেটিও ভেঙ্গে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বর্তমানে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা ৯০ জন। অথচ দুই বছর আগেও দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল।
৫ নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য নারায়ন বিশ্বাস বলেন, এ এলাকায় বন্যা নেই। তবে, ভাঙনের কারণে শত শত মানুষকে যেখানে-সেখানে থাকতে হচ্ছে। তেতুলিয়া বিলীন হওয়ার পর চরবকজুড়ি ও কামঠানা গ্রাম ভাঙছে। বলা যায় সবাই সর্বহারা হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তেতুলিয়া গ্রামে নান্নু মোল্যার বাড়ির অর্ধেকের বেশি মধুমতি নদী গর্ভে চলে গেছে। টিনের ঘরগুলো খুলে নিয়ে গেছেন তারা। ফাঁকা জায়গায় পড়ে আছে ধানের গোলা, মাইঠ (ধান বা শস্য রাখার মাটির পাত্র বিশেষ), ভাঙাচেরা আসবাবপত্রসহ গাছপালা। আর খুপড়ি রান্নাঘরটি দাঁড়িয়ে আছে বসতভিটার এককোণে। এই বাড়ির গৃহকর্ত্রী হামিদা বেগম (৫৫) বলেন, ‘চুরি করে নিলেও ঘরবাড়ি থাহে, আগুনে পুড়লেও পোতা (ভিটেমাটি) থাহে; কিন্তু নদীতে ভাঙলে কিছুই থাহে না। নদীর কাজ নদী করে যাচ্ছে, দিনরাত ভাঙ্গে যাচ্ছে। ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা নেই।’ তিনি আরো বলেন, নদী ভাঙনে বাড়িঘর হারানোর ভয় ও চিন্তায় আমার স্বামী গত কোরবানির ঈদের এক সপ্তাহ পর ব্রেনস্টোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আমার সংসারে দুই ছেলে এবং চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। এখন আমরা কোথায় যাবো? আপাঃতত বাগানের মধ্যে ঘর উঠিয়ে কোনো ভাবে থাকার ব্যবস্থা করেছি।
নান্নু মোল্যার স্ত্রী মাছুরা বেগম বলেন, নদী ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে আমার দেড় বছরের শিশুকে নিয়ে রোদ, বৃষ্টিতে অনেক কষ্টে আছি। আমরা কিছু চাই না, সরকার আমাদের নদী ভাঙন ঠেকিয়ে দিক, একটু মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে দিক। কামঠানা গ্রামের হামিদুল শেখ বলেন, তিনবার নদী ভাঙনে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষের কাছে অনেকবার আমাদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি। এখন পরের বাড়ি থাকি, কৃষি কাজ করি। তেতুলিয়া গ্রামের মগরেব মোল্যা বলেন, আমার বাড়ি সাতবার ভেঙে গেছে। আমাদের ঈদগাহ পর্যন্ত ভেঙ্গে গেছে। এবার কোথায় ঈদ নামাজ পড়ব, কী করব? এবার এলাকাবাসীর মনে ঈদ আনন্দ নেই। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, একটা গ্রাম (তেতুলিয়া) নদীতে চলে গেল, অথচ সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। মমরেজ মোল্যা বলেন, নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি, জমিজমা সব হারিয়ে তেতুলিয়া ও কামঠানা গ্রামের শত শত মানুষ এখন ফকিরের মতো। বেশির ভাগ এখন কৃষাণ বিক্রি (শ্রম বিক্রি) করে খায়। ২০ বছর ধরে ভাঙলেও কেউ কোনো কাজ করেনি।
তোরাপ মোল্যা বলেন, পাঁচবার বাড়িঘর সরানো হয়েছে। খুব অসহায় অবস্থায় আছি। এছাড়া আমাদের মসজিদ ও কবরস্থান নদীগর্ভে চলে গেছে। সরকারের কাছে আমাদের-একটাই দাবি, পাথর দিয়ে নদীটা যেন বেঁধে দেয়। চরবকজুড়ি গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস মোল্যার স্ত্রী জাহানারা বেগম বলেন, নদী ভাঙনে সব হারিয়ে এখন পরের জায়গা বসবাস করি। গৃহবধূ আসমা আক্তার সাথী বলেন, তিনদিনে আমাদের ৬০ শতক জমি নদীতে চলে গেছে। এছাড়া তাল গাছ, দশটি নারকেল গাছ, দু’টি বাঁশঝাড় এবং ৩০০ মেহগনি গাছের অর্ধেক নদীতে বিলীন হয়েছে। গত পাঁচদিনে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। আর ছয় মাস আগে বাড়িঘর সরিয়ে অন্যত্র নেয়া হয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, পাশাপাশি এ এলাকার মানুষকে পুনর্বাসন এবং আর্থিক ও খাদ্য সহযোগিতা করা হয়নি।
চরবকজুড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা চরবকজুড়ির হোসেন চৌকিদারসহ এ এলাকার কয়েকটি পরিবার গত ১৯ আগস্ট তাদের টিনের ঘর খুলে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ খুলছেন চালা, কেউ বেড়া, কেউবা ঘর থেকে বের করছেন আসবাবপত্র। বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য মোবাইল ফোনে অনুরোধ করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। এছাড়া বিভিন্ন আকারের মেহগনি গাছগুলো কেটে দ্রুত সরিয়ে নিচ্ছেন। ওই এলাকার আলেক মোল্যার স্ত্রী বেগম বিবি বলেন, নদী ভাঙনের কারণে বসতঘর ভেঙ্গে এনে পরের জায়গার ওপর রাখছি। এই অবস্থার মধ্যে অসুস্থ স্বামী এবং প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে কী যে কষ্টে আছি। সংসারে আয় করার মতো তেমন কেউ নেই। এখন শেষ সম্বল ভিটেমাটিটুকুও শেষ হয়ে গেল। প্রতিবেশি বাঁকা ফকিরের স্ত্রী সালেহা বেগম বলেন, বসতভিটায় ১২ শতক জমি ছিল। দুইবার নদী ভাঙনের শিকার হয়ে সব শেষ হয়ে গেছে। এখন চরবকজুড়িতে রাস্তায় পাশে বসবাস করছি।
লোহাগড়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মান্টু সিকদার জানান, ছাগলছিঁড়া-আমডাঙ্গা-চরবকজুড়ি থেকে লোহাগড়া উপজেলা সদরে যাতায়াতের কাঁচা রান্তার প্রায় এক কিলোমিটার অংশ এখন মধুমতি নদীগর্ভে। এছাড়া ভাঙনের তীব্রতায় এ এলাকার বিদ্যুৎ এবং ডিশ লাইনও খুলে ফেলেছেন ভূক্তভোগীরা। এ পরিস্থিতিতে নিদারুণ কষ্ট ও ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন সবাই। লোহাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল সিকদার বলেন, আমার নির্বাচিত এলাকার মধ্যে ‘তেতুলিয়া’ ওয়ার্ড মানচিত্রে থাকলেও দৃশ্যমান নেই। এখানে কোনো জনবসতি থাকার মতো অবস্থা নেই। নদী ভাঙনে সব শেষ হয়ে গেছে। বর্তমান সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে নদী শাসনে কাজ করলেও আমার এলাকায় কোনো কাজ হয়নি। ভাঙন রোধে দ্রুত কাজ না করলে তেতুলিয়ার পাশের গ্রাম ছাগলছিঁড়া, কামঠানা ও চরবকজুড়িও বিলীন হয়ে যেতে পারে। আশা করছি প্রধানমন্ত্রী এ এলাকায় অসহায় মানুষের দুর্দশার কথা বিবেচনা করে ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা নিবেন।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানেওয়াজ তালুকদার বলেন, সাংবাদিকদের মাধ্যমে খবর পেয়ে তেতুলিয়ার ভাঙন কবলিত অংশ পরিদর্শন করেছি। ওই এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা দেখা দিয়েছে। এজন্য কিছু ঘরবাড়ি সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন হয়েছে। বিষয়টি উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি। প্রয়োজনীয় বাজেট পেলে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।