শনিবার ● ১০ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
প্রথম পাতা » কৃষি » ডুমুরিয়ায় চুই’র চারা কৃষির নতুন দুয়ার
ডুমুরিয়ায় চুই’র চারা কৃষির নতুন দুয়ার
অরুন দেবনাথ।। ডুমুরিয়া থেকে।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুই ঝালের মাংশের জন্য খ্যাতির কথা এ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু এবার উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্যোগে ডুমুরিয়া থেকেই সারাদেশে সেই চুই গাছের চারা সরবরাহ করে কৃষকের কাছে আর্থিক সম্ভবনার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও চারা উৎপাদনকারী কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে ডুমুরিয়া অঞ্চলে চুই ঝাল দিয়ে মাংশ ও মাছ রান্না’র ঐতিহ্য বিদ্যমান। সাধারণতঃ ঝালের পাশাপাশি চুই দিলে মাংশের অন্যরকম স্বাদ তৈরি হয়। ডুমুরিয়ার চুকনগরে আব্বাস’র হোটেলে চুই ঝাল দিয়ে খাঁশির ভোনা মাংশের খ্যাতি এ অঞ্চলের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জানা। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক খ্যাতিমান মানুষের পাশাপাশি আম-জনতাও এ হোটেলে খাসির মাংশের স্বাদ পরখ করতে আসেন। এক সময়ের ছোট্ট ওই হোটেলটির বদৌলতে আব্বাসের ছেলেরা এখন গাড়ি-বাড়িসহ অনেক সম্পদের মালিক হয়েছে। আব্বাসের হোটেলের নামে খুলনা সদরসহ গল্লামারী জিরো পয়েন্টে বিশাল শাখা হোটেলও খোলা হয়েছে। তাছাড়া তাদের সাফল্য দেখে চুকনগর বাজার ডুমুরিয়া বাজার ও জিরো পয়েন্টে খাসির পাশাপাশি চুই ঝালের গরুর মাংশেরও অনেক বড় বড় হোটেল গড়ে রমরমা ব্যবসা চালাচ্ছে। দিনে দিনে খুলনা অঞ্চলের এই চুই’র চাহিদা সারা দেশে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই চুই’র চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্যোগে ২০১৫ সাল থেকে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চুই’র চারা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর চলতি বছর ডুমুরিয়া কৃষি অফিসের মাধ্যমে ব্যাপক হারে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে চুই ঝালের চারা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে সামান্য ব্যয়ে মাত্র দুই মাসেই তৈরি হওয়া ওই চারা খামার থেকেই ৩০ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি হওয়ায় বড় লাভের মুখ দেখার পাশাপাশি কৃষকের সামনে এক নতুন দুয়ার খুলে গেছে।
চুই’র চারা তৈরির বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার নজরুল ইসলাম বলেন, ডুমুরিয়া তথা দক্ষিণ খুলনাঞ্চলে চুই’র প্রতি মানুষের আগ্রহ দেখে দ্বিতীয় শস্য বহুমুখি প্রকল্প থেকে আমরা ২০১৫ সালে পাইকগাছা থেকে এক হাজার চারা এনে উপজেলার ভান্ডারপাড়া ও রংপুরে ইউনিয়নের ৫৫ জন কৃষকের মাঝে ২০টি করে চারা বিতরণ করি। তাদের সাফল্য দেখে ২০১৬’র শুরুতেই যশোরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় শস্য বহুমুখি প্রকল্পের মিটিং-এ আমাদের চারা উৎপাদনের প্রস্তাব পাশ হয়। তখন থেকেই ভান্ডারপাড়া ও সাহস ইউনিয়নের দুই অবস্থাপন্ন দুই আধুনিক কৃষককে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাদের মাধ্যমে চারা উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করি। ফেসবুকে চুই’র চারার খবর দেখে আমাদের মাধ্যমেই ইতোমধ্যে খুলনার দৌলতপুর, মোল্লারহাট, মোকছেদপুর, টঙ্গিপাড়া, ঝিকরগাছা, হরিণাকুন্ডু, মহেশপুর, কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদা সদর, সাতক্ষীরা-সহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বেশ কয়েক হাজার চারা কিনে নিয়ে গেছে। এছাড়া আরও বেশ কয়েক হাজার চারার অর্ডার আসছে। এখন চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে ভান্ডারপাড়া ইউনিয়নের চুই চারা উৎপাদনকারী অশোক বৈরাগী(৫৫) বলেন, কৃষি অফিসের পরামর্শে প্রস্তুতি নিয়ে ২০১৬’র মার্চে মাত্র তিন হাজার টাকায় একটা বড় চুই’র ঝাড় কিনেছিলাম। মাত্র এক শতক জমিতে ১৫’শ টাকা খরচ করে মাত্র দুই মাসেই আমার দুই হাজার চারা উৎপন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে ৯’শ চারা ৩০ হাজার টাকা বিক্রে করেছি। আশা করছি আরও ৪০ হাজার টাকার চারা বিক্রি হবে। আমি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন প্রজাতিন চারা উৎপাদন বিক্রি করে থাকি। কিন্তু এতো কম খরচে, কম সময়ে, ও কম জমিতে এতো লাভ কোনো কিছুতেই পাইনি। তাই আমাকে দেখে গ্রামের অনেকেই চুই চারা তৈরি শুরু করেছে। অনুরুপ ভাবে সাহস ইউনিয়নের সম্পন্ন কৃষক হায়দার আলী শেখ বলেন, ২০১৫ শেষ দিকে চুই উৎপাদনের জন্য পাইকগাছা থেকে ৪৫ হাজার টাকায় ১৫’শ চারা কিনে এনে ৬০ শতক জমিতে লাগাই। কিন্তু অতিবর্ষণে ছত্রাক রোগে আমার সব চারা মারা যায়। তখন কৃষি অফিস আমার পাশে এসে দাড়িয়ে চুই’র চারা উৎপাদনের পরামর্শ দেয়। তখন প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৬’র সেপ্টেম্বরে আমি বটিয়াঘাটার হাট থেকে ১০০/- কেজি দরে ৫০ কেজি চুই’র ছড়া(ছোট ডাল) কিনে এনে চারা উৎপাদন শুরু করি। মাত্র দুই মাস পরে চারা বিক্রির উপযোগী হয়েছে। আর এক মাসেই সম্পূর্ণ হবে। আমার চারা দেখে এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়েছে। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা কৃষি অফিস থেকে সরাসরি আমার কাছে ১ হাজার চারার অর্ডার দিয়েছে। আরও অর্ডারের জন্য ফোন আসছে। আশা করছি গত বছরের দেড় লাখ টাকার ক্ষতি উঠে যাবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনিস্টিটিউট, দৌলতপুর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হারুনর রশিদ বলেন, চুই গাছ দেখতে অনেকটা পান বা গোল মরিচের গাছের মতো। স্বাস্থ্যসম্মত আয়ুর্বেদিক গুণ সম্পন্ন চুই দিয়ে মাংশ বা তকোরি রান্না করলে সুঘ্রাণ আসে, ঝাল ও স্বাদ বেড়ে যায়। তাছাড়া বাতজ¦র, রক্ত পরিষ্কার ও হজমে সহয়তা করে। আর অল্প জমিতে চুই চাষ করে বছরে লাখ লাখ টাকা আয় করাও সম্ভব।
মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, খুব ছোট বেলা থেকেই দেখছি, আমাদের এলাকায় বাড়িতে-বাড়িতে যেমন চুই’র চাষ হয় তেমনি মা-বোনেরা মাংশসহ বিভিন্ন তরকারি বা ডাল রান্নায় চুই ব্যবহার করে থাকেন। এর ওষুধি গুনও অনেক। এখন ডুমুরিয়ার চুই’র চারা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ায় আমার এলাকার কৃষকের যেমন নতুন দিগন্ত খুলছে, তেমনি বিভিন্ন জায়গার মানুষের রসনাও পরিতৃপ্ত হবে।